ফরিদা বললেন, হ্যাঁ।
বীণার হাত-টাত একেবারে খালি। ছোট-খাটো কিছু গয়না গড়িয়ে দিও। এই বয়সে শখ থাকে। আমি টাকার ব্যবস্থা করব।
ফরিদা কিছু বললেন না। মিজান সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, কাল কিছু মিষ্টি টিষ্টি আনিও। মেয়েটা এত ভালো করেছে। পাশের বাসায় দিও।
আচ্ছা।
বুলু আসে নি?
না।
জুতিয়ে হারামজাদার আমি বিষ ঝাড়ব।
ফরিদা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ছেলেটা কোথায় ঘুরছে কে জানে। রাতে হয়ত কিছু খায়ও নি।
বীণা তার দাদীর সঙ্গে এক খাটে ঘুমায়। রাতে যখন বীণা ঘুমুতে আসে তখন এই অপ্রকৃতিস্থ বৃদ্ধা সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন। বীণার তখন ধারণা হয় দাদী আসলে ভালেই আছেন। পাগলামী যা করেন তা বোধ হয় ভান।
আজ বীণা ঘুমুতে এসে দেখল দাদীর গায়ের ওপরের অংশে কোনো কাপড় নেই। শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে রেখেছেন।
বীণা বলল, শাড়ি ঠিকমতো পর দাদী, বিশ্রী লাগছে।
গরম লাগে।
খুব খারাপ দেখায় দাদী।
দেখাইলে দেখায়। তুই ঘুমা।
বীণা শুয়ে পড়ল। দাদী বসেই রইলেন। বীণা বলল, ঘুমুবে না দাদী?
উঁহুঁ।
আমি পাশ করেছি দাদী।
বুলু ফেল হইছে?
বীণা কিছু বলল না।
ঐ হারামজাদা আছে কোন হানে?
ঘুমাও দাদী।
দাদী শুয়ে পড়লেন। অল্পক্ষণেই তাঁর নাক ডাকতে লাগল। তাঁর ঘুম চট করে আসে আবার চট করে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে। তখন অনবরত কথা বলতে থাকবেন।
বীণার ঘুম আসছে না, শুয়ে শুয়ে সে নানান কথা ভাবছে। কাল সে মার কাছ। থেকে টাকা নিয়ে একা একা খানিকক্ষণ ঘুরবে। অলিকের বাসা খুঁজে বের করতে পারলে একবার যাবে দেখা করতে। অলিকের কথা তার প্রায়ই মনে হয়।
দাদীর ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি উঠে বসলেন, টেনে টেনে বললেন, বুলুটা কি আবার ফেইল করল? ও বীণা, ঐ হারামজাদা আবার ফেইল করল? পর-পর তিনবার। হারামজাদার লজ্জা নাই? ও বীণা ঘুমালি?
বীণা ঘুমায় নি কিন্তু সে জবাব দিল না। জবাব দিলে দাদী অনবরত কথা বলতে থাকবেন।
ও বীণা। বীণা।
জবাব দেবে না দেবে না করেও বীণা বলল, কি দাদী?
তোর বাপ তোর বিয়ার ব্যবস্থা করে না ক্যান?
চুপ কর তো দাদী।
তার বাপরে আমি বলব। তোর বাপটার মাথা খারাপ—এত বড় মাইয়া ঘরে….
চুপ কর দাদী। তুমি বিশ্রী সব কথা বল।
শরম লাগে? ইস্ কি যে যন্ত্রণা। হা শরম লাগে।
বুড়ি গা দুলিয়ে খিক খিক করে সে। মাঝেমাঝে রাত দুপুরে তাঁর মনে ফুর্তির ভাব আসে। আজ বোধ হয় সে রকম একটা রাত। বুড়ি নিচু গলায় মেয়েদের যৌবন নিয়ে এমন একটা কথা বলল যে বীণার কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর অলিকের একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে—দুপুরে ঘুমানো। তাদের সব ক্লাস দেড়টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। একটা সাবসিডিয়ারি ক্লাস আছে তিনটায়। সপ্তাহে একদিন। সাবসিডিয়ারির স্যার একদিন আসেন তো তিন দিন আসেন না। পড়ানোরও কোনো আগা মাথা নেই, একদিন যেটা পড়ালেন পরদিন আবার সেটাই শুরু করলেন। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে রাগীরাগী গলায় বলেন, বেশি বুঝতে চেষ্টা করবে না। যতুটুকু বোঝার ততটুকুই বুঝতে চেষ্টা কর। নো মোর, নো লেস।
বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অলিকের মোহ কেটে গেছে। সাবসিডিয়ারি ক্লাসে যাওয়া সে ছেড়ে দিয়েছে। অনার্স ক্লাসও সব কটি করা হয় না। তার ধারণা একটি ক্লাস না করেও ঘরে বসে পড়ে সে চমৎকার রেজাল্ট করে বের হয়ে আসবে। তবে কোনো কোনো টিচার রোলকল করেন। যে কারণে তাঁদের ক্লাস করতে হয়। ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস খুব মজার হবার কথা, তা হয় না। অধিকাংশ ক্লাসই অঙ্কের ক্লাসের মতো মনে হয়। সাহিত্য এত রসকষহীন হবে জানলে সে ইকনমিক্স কিংবা সাইকোলজি নিয়ে নিত।
আজ বুধবার বি আর এর ক্লাস। এই ক্লাসটা মোটামুটি ভালোই হয়। বি আর মন্দ পড়ান না। প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস পড়তে ভালোই লাগে। যদিও উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ওপর রাগে গা জ্বলে যায়।
অলিক ক্লাসে গিয়েছিল। ক্লাস হল না। তাদের ক্লাস রুমের ঠিক সামনে একটা বোমা ফেটেছে। মেঝেতে ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়ানো। বোমা ফাটার কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্যি সব শান্ত তবু বি আর ক্লাস নিলেন না। বিরক্ত মুখে বললেন, পড়াশোনা করে কী হবে? যাও বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও। অলিক স্যারের কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছে। বাড়িতে এসে কিছু না খেয়েই ঘুম। দরজার বাইরে হাতে লেখা। নোটিশদয়া করে বিরক্ত করবেন না।
কেউ তাকে বিরক্ত করল না। অবশ্যি বিরক্ত করার মানুষও এ বাড়িতে নেই। বাবা বনানী থেকে ফিরবেন রাত আটটার দিকে। বনানীতে তাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ঐ নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত। এ বাড়িতে অন্য যারা আছে তারা অলিককে বেশ ভয় করে। যদিও ভয় করার তেমন কোনো কারণ নেই। অলিক কারো সঙ্গেই উঁচু গলায় কথা বলে না।
তার ঘুম ভাঙল বিকেলে। বিকেলে ঘুম ভাঙলে তার খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে কে জানে। তখন খুব এক জনপ্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। মুশকিল হচ্ছে অলিকের তেমন কোনো প্রিয়জন নেই। মাঝে-মাঝে ঘুম ভাঙা মাত্রই সে টেলিফোন তুলে চোখ বন্ধ করে ছটা নাম্বার ঘুরায়। বেশিরভাগ সময় কোনো শব্দ হয় না। আবার মাঝে-মাঝে রিং হয়। তখন দারুণ উত্তেজনার একটা ব্যাপার ঘটেকে টেলিফোন ধরবে? একটি ছেলে ধরবে, না মেয়ে? যদি কোনো ছেলে ধরে তাহলে সে কেমন ছেলে? বুদ্ধিমান না ইডিয়ট শ্রেণীর? ওপার থেকে উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো। অলিক টেলিফোন নামিয়ে রাখে।