যাব কোথায় স্যার? যাওয়ার তো কোন জায়গা নেই।
মিজান সাহেব শীতল গলায় বললেন, আমি চাকরি করব না বলে ঠিক করেছি।
কী বলছেন স্যার?
রেজিগনেশন লেটার লিখে অফিসে দিয়ে এসেছি। ওরা গনি সাহেবকে দেবে।
আপনার সংসার চলবে কী ভাবে স্যার?
না চললে চলবে না। তুমি কি একটা সিগারেট খাবে রহমান?
জ্বি না স্যার। আপনার সামনে খাব না।
নাও। কোন অসুবিধা নেই।
মিজান সাহেব রহমানের পিঠে হাত রাখলেন। রহমান শব্দ করে কাঁদতে লাগল।
ফরিদা আবার ঐ মেয়েটিকে দেখলেন
অনেকদিন পর ফরিদা আবার ঐ মেয়েটিকে দেখলেন। ঘোমটা দেয়া মেয়েটা, কুয়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
সন্ধ্যা মাত্র মিলিয়েছে। আকাশ মেঘে ঢাকা বলে একটু বেশি অন্ধকার। তবু তার মধ্যেও মেয়েটিকে পরিষ্কার দেখা গেল। তিনি প্রথমে ভাবলেন বীণা। পর মুহূর্তেই মনে হল—না এতো বীণা না। তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কে ওখানে? মেয়েটা চট করে চাঁপা গাছের আড়ালে চলে গেল।
তাঁর বুক ধক করে উঠল। ঘরে তিনি এবং তাঁর শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই গেছে বুলুর কাছে। বুলুর অবস্থা খারাপ হয়েছে। আজ তার পা কেটে বাদ দেয়া হবে। অপারেশন সন্ধ্যার পর পরই হবার কথা। তিনি যেতে চেয়েছিলেন যেতে পারেন। নি। সকাল থেকেই বুকের ব্যথায় কাতর হয়েছেন। আজকের ব্যথাটা অন্য যে কোনো দিনের চেয়েও তীব্র। সন্ধ্যাবেলা একটু কমেছিল। নামাজের অজু করার জন্যে বারান্দায় এসে এই দৃশ্য দেখলেন। তিনি আবার কাঁপা গলায় বললেন, কে কে কে?
তাঁর শাশুড়ি বললেন, কি হইল বৌমা?
ফরিদা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ভয় পেয়েছি। আম্মা ভয় পেয়েছি।
বৌমা ভয়ের কিছু নাই। আর আমার কাছে। আয়াতুল কুরসি পইড়া বুকে ফুঁ দিব। আস আমার কাছে গোমা।
ফরিদার সমস্ত শরীর কেমন যেন জমে গেছে। তিনি নড়তে পারছেন না। চাঁপা গাছের আড়াল থেকে ঘোমটা পরা মেয়েটি আবার বের হয়ে এসেছে। ফরিদা স্পষ্ট দেখলেন মেয়েটা তার ঘোমটা ফেলে দিল। কি অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ে অথচ তাকে এত ভয়ংকর লাগছে কেন?
ফরিদা ক্ষীর্ণ স্বরে ডাকলেন, আম্মা ভয় লাগে। আম্মা ভয় লাগে।
তাঁর শাশুড়ি ক্ৰমাগত ডাকছেন, আমার লক্ষী মা, কাছে আস। আমি বিছনা থাইকা নামতে পারছি নাগোমা। তুমি আমার কাছে আস।
মৃত রোগীর আত্মীয়
ডাক্তাররা মৃত রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে সাধারণত কোনো কথা বলতে চান না। কিন্তু এই ডাক্তার বললেন। অপারেশন থিয়েটারের বাইরের কাঠের বেঞ্চিতে বসে থাকা মিজান সাহেবের সামনে এসে স্পষ্ট গলায় বললেন, আমি খুবই লজ্জিত।
মিজান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, লজ্জিত হবার কী আছে। চেষ্টার ত্রুটি যদি হত তাহলে লজ্জার ব্যাপার ছিল। চেষ্টার কোন ত্ৰুটি করেন নি।
ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন না দাঁড়িয়ে রইলেন। মিজান সাহেব বললেন, মৃত্যুর সময় বুলু কি কিছু বলেছিল?
জ্বি না। ওর জ্ঞান ফেরে নি।
এই প্রথম মিজান সাহেবের চোখে পানি দেখা গেল। তিনি রুমাল বের করে চোখ মুছে সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমার এই ছেলেটা বড় ভালো ছিল ডাক্তার সাহেব। আমার মনে একটা ক্ষুদ্র আফসোস রয়ে গেল—আমি যে তাকে কতটা ভালবাসতাম এটা সে জানতে পারল না।
ডাক্তার সাহেব স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। মিজান সাহেব বললেন, বুলু আপনাকে একটা উপহার দিতে চেয়েছিল। ওর ইচ্ছা ছিল অপারেশনের পর জ্ঞান যখন ফিরবে তখন সে নিজের হাতে আপনাকে দেবে। আমি উপহারটা নিয়ে এসেছি। আপনি যদি উপহারটা নেন আমি খুব খুশী হব। তেমন কিছু না। সামান্য একটা কলম। অল্প দাম।
মিজান সাহেব পাঞ্জাবির পকেটে কলম খুঁজতে লাগলেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি আপনার বাচ্চাদের কাছে যান। ওরা খুব কান্নাকাটি করছে। আসুন। আমার হাত ধরুন।
সুন্দর একটা চিঠি
অলিক আমেরিকা থেকে সুন্দর একটা চিঠি লিখেছে। চিঠিতে জীবনের চমৎকার সব ঘটনা এত সুন্দর করে লেখা। বার-বার পড়তে ইচ্ছা করে।
চিঠি শেষ করবার আগে বুলুর কথা লিখল। বীণার কথা লিখল। কি সুন্দর করেই না লিখল—
বীণা, তোর ভাইটা খুব ভালমানুষ ধরনের ছিল। ভাগ্যিস তার সঙ্গে আমার বেশি দেখা টেখা হয় নি। হলে নির্ধাৎ প্রেমে পড়ে যেতাম। আর ওইরকম কিছু ঘটলে কি হত বল তো! দুদিন মাত্র তার সঙ্গে দেখা। অল্প কিছু কথা হল তাতেই আজ আমার এমন কষ্ট হচ্ছে। জানি না তোরা কী করে সহ্য করছিস! কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের অসাধারণ তবুও তার একটা সীমা আছে। তুই লিখেছিস জ্ঞান ফিরবার পর নানান কথার এক ফাঁকে তোর ভাই আমার চিঠিটা পড়তে চেয়েছিল।
জানতে চেয়েছিল আমি কেমন আছি। আমার বড় আনন্দ হল যে এক জন মৃত্যুপথযাত্রী অন্য এক জনের কুশল জানতে চায়। সেই এক জন হচ্ছে আমার মতো এক জন। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। পরকাল আছে কিনা কে জানে। যদি থাকে তাহলে তোর আদরের ভাই সেখানে পরম সুখে থাকবে। এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
তোর বিয়ের কথা হচ্ছিল সেই বিয়ে ভেঙে গেল জেনে ভালো লাগছে। তুই বিয়ে করলে ওদের এখন কে দেখবে? তোকে এখন হাল ধরতে হবে না? আমি জানি সেই হাল তুই শক্ত করে ধরবি। মেয়েদের নরম হাত মাঝে-মাঝে বজের মত কঠিন হয়ে যায়। সময়ই তা করে দেয়। ভোর বেলায়ও করবে।
আমি ভালো আছি। সত্যি ভালো। ডাক্তাররা অসুখ ধরতে পেরেছেন। দাগ মুছে যাচ্ছে। চাঁদে এখন আর কোন কলঙ্ক নেই।