বুঝতে না পেরেও মিজান সাহেব হা সূচক মাথা নাড়েন। মাসের মধ্যে এক দুদিন গনি সাহেবকে দেশ নিয়ে খুবই চিন্তিত মনে হয়। সুরমা পরা চোখে দেশের জন্যে মমতা ঝরে পড়ে। তিনি উদাস গলায় বার-বার বলেন, চিন্তা করে কিছু বের করুন। ভাবুন। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন।
মিজান সাহেব ভাবেন। তবে দেশ নিয়ে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। ইদানীং তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন। বুলু এইবারও পাশ করতে পারে নি। তিনবার বি.এ ফেল করলে আর কোনোবারই পাশ করতে পারে না। এটাই নাকি নিয়ম। পাশ যারা করার তারা প্রথম দুবারেই করে। যারা করার না তারা আর করে না।
বুলু পাশ করতে পারল না অথচ বীণা এত ভালো রেজাল্ট করল। বীণার এই রকম রেজাল্টের দরকার ছিল না। দুজন যদি কোনোেমতে টেনে-টুনেও পাশ করত তিনি খুশি হতেন।
শ্রাবণ মাসের এই মেঘলা সকালে মিজান সাহেব রেজাল্টের পত্রিকা হাতে বারান্দায় জলচৌকির উপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। বুলু বোধ হয় আগেই খবর পেয়েছে। সে গতরাত থেকে বাসায় নেই। ফরিদা খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করে এখন নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। তাঁর বুকের ফিক ব্যথা আবার উঠেছে।
বীণা কয়ার পাশে একা একা বসে আছে। সেও খানিকক্ষণ কেটেছে। বি, এ পরীক্ষায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় হবার কোন দরকার ছিল না। সে তো এমন কোনো ভালো ছাত্রী না। ম্যাট্রিকে একটা মাত্ৰ লেটার পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছিল। অথচ তার বান্ধবীরা চারটা পাঁচটা করে লেটার পেয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটেও অনেক কষ্টে একটা ফার্স্ট ডিভিসন। এই গুলোও কোনো কাজে লাগল না। ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় এ্যালাউ হল না।
বীণার খুব খারাপ লাগছে তার দাদার জন্যে। বেচারা এ বছর খুব পরিশ্রম করেছে। তবু এ রকম হল কেন কে জানে। বেচারা সোজা সরল ধরনের মানুষ। একা একা কোথায় ঘুরছে কে জানে। সে ফেল করে তার দাদা পাশ করলে আনন্দের একটা ব্যাপার হত। বাবা নিশ্চয়ই মিষ্টি আনতেন। সে তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকত। এক সময় বাবা বলতেন, এত কান্নাকাটির কি আছে? পাশ ফেল ভাগ্যের ব্যাপার। পরের বছর আরেকবার দিলেই হবে।
আবহাওয়া সহজ হয়ে যেত। বাবাকে জলচৌকির ওপর মুখ শুকনো করে বসে থাকতে হত না। ফিক ব্যথা উঠত না। বীণাকে একা একা কুয়ার পাশে থাকতে হত না।
কিংবা তারা দুই ভাই-বোনই যদি পাশ করত তাহলে কি অদ্ভুত একটা ব্যাপার। হত। দুজনে মিলে সালাম করত বাবা মাকে। বাবা গম্ভীর গলায় বলতেন, থাক থাক সালাম লাগবে না। বলতে বলতে গাম্ভীর্যের কথা ভুলে তরল গলায় নিশ্চয় বলতেন, ফরিদা, মিষ্টি-টিষ্টির ব্যবস্থা কর।
বীণা এক দৃষ্টিতে কুয়ার পানির দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ নিচু করে একবার সে বলল, নাবী, নাবী। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়া গম্ভীর গলায় ডাকল, বীণা। বীণা। কুয়া কি চমৎকার করেই না মানুষের মতো ডাকে। প্রাচীন এক জন মানুষ, যার গলার স্বরে ব্যাখ্যার অতীত কোনো রহস্যময়তা।
আপা, এই আপা।
বীণা পেছনে ফিরল। লীনা পা টিপে টিপে আসছে। বীণা বলল, কিরে?
বাবা চা খেতে চাচ্ছে।
বীণা রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। তার পেছনে পেছনে লীনা আসছে। সে ফিস-ফিস করে বলল, তুমি ফার্স্ট হয়েছ আপা?
না।
পত্রিকায় তোমার ছবি উঠবে না?
বীণা কিছু বলল না। লীনা বলল, ওরা তোমার ছবি কোথায় পাবে আপা?
জানি না। এত কথা বলিস না, ভালো লাগছে না।
বীণা চা বানিয়ে বাইরে এসে দেখে বাবা নেই। কাউকে কিছু বলে চলে গেছেন। খবরের কাগজটা কুচি-কুচি করে ছেড়া।
লীনা বলল, চা আমাকে দাও আপা আমি খেয়ে ফেলি।
বীণা চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। মার জন্যে হালকা করে সাগু বানাল। সাগু খেলে ব্যথা খানিকটা কমে। ফরিদার ব্যথা কমল না। তিনি ছটফট করতে লাগলেন।
মিজান সাহেব বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যা মিলাবার পর। তাঁর হাতে একগাদা কাগজপত্র। ক্যাশের হিসাবে গণ্ডগোল হচ্ছে। রাত জেগে হিসাব মিলাবেন। তিনি হাত মুখ ধুয়ে খাতা নিয়ে বসলেন। পাশের ঘরে ফরিদা ছটফট করছেন—তা নিয়ে মোটেই বিচলিত হলেন না। কখনো হন না।
বীণা এসে বলল, চা দেব বাবা?
তিনি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না।
বীণা চা বানিয়ে বাবার পাশে রাখল। বাবার কাছাকাছি সে বেশিক্ষণ থাকে না। খুব ভয়-ভয় লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি ভয় করছে। বীণা চলে যেতে ধরেছে-মিজান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, বোস।
বীণা হকচকিয়ে গেল। বসল না। মিজান সাহেব পকেট থেকে একটা ছোট্ট চৌকা বাক্স বের করে মৃদু স্বরে বললেন, নে।
বীণা হাত বাড়িয়ে নিল। বাক্স খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল। একটা সোনালি হাত ঘড়ি। বীণা কী করবে ভেবে পেল না। মিজান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এত ভালো রেজাল্ট করেছিস-বাবা মাকে তো সালাম করলি না? সালাম কর মা!
রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। ঘরে ইলেকট্রিসিটি নেই। দমকা বাতাসের ঝাপটা। সারা বাড়িতে একটা মাত্র হারিকেন। মিজান সাহেব সেই হারিকেনে খাপত্ৰ দেখছেন। লীনা এবং বাবলু অন্ধকার বারান্দায় বসে আছে। আপার ঘড়িটা লীনা হাতে পরেছে। তার বড় ভালো লাগছে।
বীণা রান্নাঘরে। চূলার আগুনের সামান্য আলোতেই রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। ফরিদা তার পাশে বসে আছেন। তাঁর ব্যথা পুরোপুরি সেরে গেছে তবে শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।
মিজান সাহেব অনেক রাতে শুতে গেলেন। ঝড় থেমে গেছে তবু অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। শীত লাগছে, কাঁথা বের করতে হয়েছে। মিজান সাহেব বিছানায় উঠতে উঠতে বললেন, ফরিদা জেগে আছ নাকি?