ফরিদা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। আনন্দে তাঁর চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। চোখের পানি সামলাতে তাঁকে খুব কষ্ট করতে হল।
বুলুর পায়ে গ্যাংগ্রিন
বুলুর পায়ে গ্যাংগ্রিন ধরা পড়েছে।
দুবার অপারেশন হল। তৃতীয় বারও সম্ভবত হবে। দুজন ডাক্তারের এক জন কিছুতেই পা এম্পুট করতে রাজি না। সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যেতে চান। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচারী মেদিনীর মতো অবস্থা। এই ডাক্তারটির বয়স অল্প। হৃদয় কঠিন হতে শুরু করে নি। তিনি রাউন্ডে এসে বুলুর বিছানার সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ান। বুলুর পা পরীক্ষা করেন। এই সময় গভীর বিরক্তিতে তার মুখ অন্যরকম হয়ে যায়। বুলু বলে, আপনি কেমন আছেন স্যার?
তিনি কঠিন গলায় বলেন, ভালো।
আমার পা কেমন দেখলেন?
তিনি জবাব দেন না। বুলু নিচু গলায় বলে, কেটে ফেলে দেবেন কবে?
সময় হলেই ফেলা হবে। আপনি চুপ করে থাকুন।
বেশিরভাগ সময় বুলু চুপ করে থাকে। একটা ঘরের মধ্যে তার সময় কাটে। তন্দ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি এক ধরনের আচ্ছন্ন অবস্থা। যে অবস্থায় চারপাশের জগৎটাকে খুবই অবাস্তব মনে হয়। তার পাশের বেডের দাড়িওয়ালা কালো মানুষটাকে এক সময় খুবই পরিচিত মনে হয় আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়—দাড়িওয়ালা এই ছাগল কে?
এই লোকটি বলকে খুব বিরক্ত করে। অকারণে কথা বলে। বলর অসহ্য লাগে বুলু বিরক্ত হয় এমন কাজগুলো সে নিষ্ঠার সঙ্গে করে। কাল দুপুরে কট কট শব্দ করে কী যেন খাচ্ছিল। শব্দটা চট করে বুলুর মাথায় ঢুকে গেল। মাথার ভেতর কট কট শব্দ হতে থাকল। বুলুর এই এক সমস্যা হয়েছে যে কোনো শব্দই চট করে মাথায় ঢুকে যায়। তারপর মাথার ভেতর সেই শব্দ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। লোকটা কট কট শব্দে খাচ্ছে সেই শব্দ পাক খাচ্ছে বুলুর মাথায়। বুলু বলল, কি খান?
লোকটি সঙ্গে-সঙ্গে টিফিন ক্যারিয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন ভাইজান খান।
না আমি খেতে চাই না। আপনি নিজেই খান, তবে দয়া করে কট কট শব্দ করবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
বুলু চোখ বন্ধ করল। যখন ঘুম এসে যাচ্ছে তখন আবার কট কট শব্দ শুরু হল। দাড়িওয়ালা লোকটা খাওয়া শুরু করেছে। বুলু থমথমে গলায় বলল, এই যে ভাই আর একবার যদি কট কট শব্দ হয় তাহলে কিন্তু ধাক্কা দিয়ে আপনাকে জানালা দিয়ে ফেলে। দেব।
জ্বি আচ্ছা।
দাড়িওয়ালা এই লোকটির নাম শামসু। একটা লেদ মেশিন চালায়। বুলু যখন কিছুটা ভালো থাকে তখন তার সঙ্গে অনেক কথা কথা বলে। লোকটি প্রতিটি বাক্যে খুব মিষ্টি করে একবার হলেও ভাইজান বলে। বুলুর শুনতে ভালো লাগে। লোকটির বেশিরভাগ কথাই হচ্ছে লেদ মেশিন সংক্রান্ত।
ভাইজান লেদ মেশিন যন্ত্রটা হইল দুনিয়ার এক আজিব চিজ।
তাই নাকি?
জ্বি ভাইজান। এই যন্ত্র যে জানে সে দুনিয়ার সবই জানে।
আপনি জানেন?
নিজের মুখে কি বলব ভাইজান আপনে ধোলাই খালে গিয়া শুধু জিজ্ঞাসা করবেন—শামসু কারিগর। দেখবেন আফনের কি খাতির।
আপনাদের কি কারিগর বলে নাকি?
না মিস্তিরি বলে। আমারে খাতির কইরা কারিগর ডাকে। আপনার সঙ্গে যখন খাতির হইল তখন আর চিন্তা নাই। কথা দিলাম আফনেরে কাজ শিখায়ে দিব।
আমি কাজ শিখে কী করব?
যন্ত্র চালাইবেন। চাকরি-বাকরি দিয়া কি হয় বলেন ভাইজান? কয় পয়সা বেতন? স্বাধীন ব্যবসার মতো জিনিস আছে?
আর কথা বলবেন না ভাই। যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। ভালো লাগছে না।
দমে দমে আল্লাহু বলেন ভাইজান।
চুপ থাকতে বললাম না।
নিঃশ্বাসটা নেওয়ার সময় বলেন আল্লা ছাড়ার সময় বলেন হুঁ। এতে কাজ হয়।
চুপ। একটা কথা না। ব্যাটা ছাগল।
শামসু দুঃখিত চোখে তাকায়। আশ্চর্যের কথা সেই দুঃখী চোখে প্রচুর মমতাও ঝরে পড়ে।
আজ বুলুর পায়ের যন্ত্রণা খুব বেড়েছে।
নার্স এসে কড়া ধরনের কোনো পেইন কিলার দিয়েছে যা তার পায়ের ব্যথা একটও না কমিয়ে মাথাটাকে কেমন ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। কানের কাছে পিন পিন শব্দ হচ্ছে। যেন বেশ কিছু মশা দুকানের ভেতর দিয়ে মাথায় ঢুকে গেছে।
রাত আটটার মতো বাজে। মিজান সাহেব ছেলের বিছানার পাশে বসে আছেন। আজ রাতটা তিনি ছেলের সঙ্গেই কাটাবেন। প্রায়ই কাটান। অফিস থেকে সরাসরি এখানে চলে আসেন। খুব যেদিন বাড়াবাড়ি দেখেন সেদিন আর বাসায় যান না।
বুলু ডাকল, বাবা।
মিজান সাহেব নড়ে চড়ে বসলেন। কিছু বললেন না। বুলু বলল, আমি পাশ না করার জন্য খুব লজ্জিত বাবা। থার্ড পেপারটা এমন খারাপ হল।
মিজান সাহেব বললেন, এটা নিয়ে পরে আলাপ করব।
পরীক্ষার হলে খুব নকল হচ্ছিল একবার ভাবলাম—তারপর বাবা মনটা সায় দিল। না।
এখন এইসব থাক।
আমি এতক্ষণ কী ভাবছিলাম জান? ভাবছিলাম যদি নকল করে পরীক্ষায় পাশ করে ফেলতাম তাহলে বাড়ি থেকে পালাতাম না। পায়ে কাঁটা ফুটত না, ডাক্তারেরা পা কেটে বাদ দিত না।
পা কাটার কথা এখনি ভাবছিস কেন? ডাক্তাররা তো চেষ্টা করছেন।
আর চেষ্টা করে কিছু হবে না।
বুলু চোখ বন্ধ করে ফেলল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
দীর্ঘ সময় একা একা বসে থাকা যায় না। মিজান সাহেব অফিসের ফাইল খুললেন। যদি টাকাটার কোনো হদিস পাওয়া যায়। ব্যাংক থেকে ছবছরের স্টেটমেন্ট নিয়ে এসেছেন। মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছেন। যদি এমন কোনো চেক বেরিয়ে পড়ে যার উল্লেখ খাতাপত্রে নেই। রেকর্ড হারিয়ে গেছে। অসম্ভব তো কিছু না।
বুলুর ঘুম ভেঙেছে। সে আগ্রহ নিয়ে তার বাবাকে দেখছে। মানুষটা কি অদ্ভুত। এর মধ্যে খাপত্র নিয়ে মগ্ন হয়ে গেছে। বুলু মৃদু সুরে ডাকল, বাবা।