মন্ত্ৰী অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন। বললেন, আপনাকে ১৫ মিনিট সময় দেয়া হল। এর মধ্যে আমরা একটা টি-ব্রেক নেব। আপনি চা মিস করলেন।
বোরহান সাহেব টেলিফোন ধরা মাত্র অলিক বলল, কেমন আছ বাবা?
বোরহান সাহেব বললেন, এইটাই কি তোমার জরুরি খবর?
হ্যাঁ। তুমি কি ভালে আছ বাবা?
রাগ করতে গিয়েও তিনি রাগ করলেন না। নরম গলায় বললেন, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
ভালো না। আমার মনটা খুব খারাপ। খুবই খারাপ।
কেন মা?
আমার বন্ধুর ভাই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। হাসপাতালের বারান্দায় বসে কাঁদছে।
দেশের অবস্থাই তো এরকম মা। হাসপাতালে সিট নেই, ঘরে খাবার নেই, অফিসে চাকরি নেই।
বাবা।
বল মা।
তুমি এক ঘন্টার মধ্যে এই ছেলেটার হাসপাতালে ভর্তি করার একটা ব্যবস্থা করবে।
সে কী?
হ্যাঁ করবে।
কি করে করব বল তো? তুই কী ভাবিস আমাকে?
এক মিনিট কিন্তু চলে গেছে বাবা। আর মাত্ৰ ৫৯ মিনিট আছে।
তুই বড় পাগলামি করিস মা।
বেশি দিন তো করব না বাবা। আর খুব অল্পদিন করব। তারপর আর করব না। ইচ্ছা থাকলেও করতে পারব না।
বোরহান সাহেব বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি।
বাহান্ন মিনিটের মাথায় বুলু ভর্তি হয়ে গেল। দেড় ঘণ্টার মধ্যে দুজন বড় বড় ডাক্তার বুলুকে দেখতে এলেন।
বুলুর পাশের বেডে সবুজ শার্ট গায়ে দাড়িওয়ালা এক জন মানুষ। সে আগ্রহ নিয়ে বলল, ভাইজান আফনের পরিচয়?
চমৎকার একটা নীল শাড়ি
অলিক আজ চমৎকার একটা নীল শাড়ি পরেছে। সেজেছেও খুব যত্ন করে। তাকে জলপরীর মতো লাগছে। ডারমাটোলজিস্ট প্রফেসর বড়ুয়া বললেন, কেমন আছ মা?
অলিক বলল, আমি ভালো আছি। আপনি সাত দিন পর আসতে বলেছিলেন, আমি এসেছি।
দেখি, তোমার দাগের কি অবস্থা।
দেখুন।
প্রফেসর বড়ুয়া দেখলেন। দাগ আরো বেড়েছে। কিছু কিছু দাগ ফ্যাকাশে হলুদ থেকে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। তিনি অবাক হয়ে দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অলিক বলল, আপনি ওষুধ বদলে এখন নতুন ওষুধ দেবেন, তাই না? আমার মার ডাক্তারও তাই করতেন।
প্রফেসর বড়ুয়া কিছু বললেন না।
বোরহান সাহেব বললেন, মেয়েটিকে কি বাইরে নিয়ে যাব?
প্রফেসর বড়ুয়া দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, নিয়ে যান।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়েই বোরহান সাহেব বললেন, তোর বান্ধবীর ভাইকে দেখতে যাবি নাকি?
না।
না কেন? চল দেখে আসি।
হাসপাতাল আমার আলো লাগে না বাবা।
বাসায় চলে যাবি?
হুঁ। আমার কাজ আছে।
কি কাজ?
খুব জরুরি একটা কাজ।
অলিকের কাজটা তেমন কিছু জরুরি না। ওডেনের একটা কবিতার ছায়ায় গত চারদিন ধরে সে নিজে একটা লিখতে চেষ্টা করছে। ওডেনের সেই সহজ ভঙ্গি তার কবিতায় আসছে না। কবিতাটা কেমন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সহজ করে লেখা এত কঠিন কেন তাই সে বুঝতে পারছে না।
বাসায় ফেরার পথে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সে মনে-মনে কবিতাটা আবৃত্তি করল।
He was fully sensible to the advantage of the installment plan.
And had everything necessary to the Modern Man.
A gramophone, a radio, a car a frigidare.
আচ্ছা এই মানুষটি কি সুখী ছিল?
যার জীবনের কোনো সাধই অপূর্ণ নয় সেকি সুখী? জীবনানন্দ দাশের লাশকাটা ঘরের ঐ মানুষটিও কি সুখী ছিল? ঐ মানুষটির স্ত্রী ছিল, শিশু ছিল, ভালবাসা ছিল। তবু তাকে লাশ কাটা ঘরে যেতে হল কেন? মনে হয় জীবনানন্দ দাশের ঐ মানুষটি সুখী ছিল তাহলে ওডেনের মানুষটি সুখী ছিল কি? ওডেনের ঐ মানুষটির তো কোনো অভাব ছিল না। তার একটা গাড়ি ছিল, একটা গ্রামোফোন ছিল, একটা ফ্রিজ ছিল।
বিয়ের কথা
মিজান সাহেব ফরিদাকে বিয়ের কথা ভেঙে কিছুই বলেন নি।
তবু ফরিদা সবই জেনে গেলেন। ছেলের এক ফুপু এসে সব রহস্য ফাঁক করে দিলেন। ছেলে দেশে থাকে না থাকে নিউ অরলিন্সে। ডাক্তারী পাশ করেছে জন সেন্ট লুক থেকে। বয়স একত্রিশ। আমেরিকার রেসিডেন্সশিপ গত বছর পেয়েছে। সে বড় হয়েছে আমেরিকাতে। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে আমেরিকায় গিয়েছিল পনের বছর বয়সে, এর মধ্যে দেশে আসে নি। এখন তিন মাসের জন্যে এসেছে। বিয়ে করে চলে যাবে। বউ মাস তিনেক পর যাবে। ভিসা টি ঠিক করতে এই সময়টা লেগে যাবে।
ছেলের ফুপু নিজেও ডাক্তার। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ করেন। ডাক্তার হয়ে যাওয়া মেয়েদের কথাবার্তা খানিকটা রুক্ষ ধরনের হয়। এই ভদ্রমহিলার তা না। তিনি বেশ মজা করে কথা বলছেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর হাসছেন। তিনি বললেন, তৌফিককে পাঠিয়ে দেব। আপনারা কথা বলে দেখুন পছন্দ হয় কিনা। কখন পাঠাব বলে দেবেন। আমরা আপনাদের খুব কাছেই থাকি। বাড়ির নাম পদ্মসখা হলুদ রঙা তিনতলা বাড়ি। দেখেছেন না?
ফরিদা সেই বাড়ি দেখেন নি তবু মাথা নাড়লেন যেন দেখেছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আমাদের ছেলে কিন্তু আপনার মেয়েকে দেখেছে। এদের মধ্যে কি সব কথাও নাকি হয়েছে। ছেলে খুবই ইমপ্রেসড। পরে যখন খোঁজ নিয়ে জানা গেল আপনার মেয়ে ছাত্রী হিসেবেও খুব ভালো তখন সে আরো ইমপ্রেসড হল। এখন বলুন ছেলেকে কখন পাঠাব?
ফরিদা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। বুলুর বাবার সঙ্গে কথা না বলে কিছুই করা। যাবে না। এখন অবস্থা এমন যে বুলুর বাবার সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না। অফিস থেকে বাসায় এসে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাসপাতালে যায়। সারা রাত থাকে হাসপাতালে। বুলুর অবস্থা নাকি ভালো না। কেন ভালো না তা ফরিদা ঠিক বুঝতে পারেন না। তিনি একবার হাসপাতালে বুলুকে দেখতে গেলেন, সে তো বেশ অনেক কথা টথা বলল। বুলু সুস্থ থাকলে বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে নেয়া যেত। অসুস্থ হয়ে হয়েছে যন্ত্ৰণা।