এই পদ্ধতির পুরোটা তাঁর নিজের না খানিকটা মুনিরের কাছে শিখেছেন। মুনির এই বয়সেই বিশাল কনস্ট্রাকশান ফার্মের মালিক। সে একদিন বলেছিল, হিসাবে একুশ লক্ষ টাকার একটা গণ্ডগোল করে রেখেছি। নিজেই করেছি। এতে লাভ কী হয়েছে জানেন, গনি সাহেব? লাভ একটাই হয়েছে—আমার সব কটা লোক কুঁচের আগায় বসে আছে। হা হা হা। সবাই ভাবছে যে-কোন মুহুর্তে চাকরি চলে যেতে পারে। অথচ যাচ্ছে না। এতে কাজ হয়। ভালো কাজ হয়। আপনি আমার বন্ধু মানুষ। আপনি টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন বলে এত দূর উঠতে পেরেছি। আপনাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিলাম। সব সময় হিসাবের একটা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রাখবেন। তারপর দেখবেন সব কেমন ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে। টিক টিক টিক টিক।
গনি সাহেব আবার মিজান সাহেবকে ডেকে পাঠালেন, মধুর স্বরে বললেন, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে মিজান সাহেব?
জ্বি।
বসুন বসুন।
তিনি বসলেন।
গনি সাহেব বললেন, দেশের জন্যে কিছু কাজ করতে চাই। কী ভাবে তা করা যায় কিছু ভেবেছেন?
জ্বি না।
ভাবুন। ভেবে বের করুন। আর আপনার ছেলেকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম না? আনছেন না কেন?
মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন।
আজই তো আনার কথা তাই না?
জ্বি।
যদি আসে সরাসরি আমার কাছে নিয়ে আসবেন। কম্পুটার সেকশনে দিয়ে দেব। ভালোমতো ট্রেনিং নিকা কম্পুটার কোম্পানি ট্রেনিং দিয়ে দেবে। কোনো অসুবিধা নেই। আপনার শরীরটা কি খারাপ নাকি?
জ্বি খারাপ।
যান, বাসায় চলে যান। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন।
মিজান সাহেব চলে যাবার পর পরই গনি সাহেব টেলিফোন পেলেন বড় জামাই বাবুকে নিয়ে ফিরেছে। অনেক দিন পর বাইরে ঘুরতে পেরে বাবু খুব খুশি। পীর সাহেব তাকে একটা কবচ দিয়েছেন। জাফরান দিয়ে কোরানের আয়াত লেখা একটা প্লেট দিয়েছেন। সেই প্লেট যোয়া পানি প্রতি বুধবার খালি পেটে খেতে হবে।
তিনি মনে মনে বললেন-হারামজাদা। গালিটা কাকে দিলেন তিনি নিজেও বুঝলেন না। নিজের জামাইদের না পীর সাহেবকে? নাকি পৃথিবীর সব মানুষদের?
তাঁর চেহারায় বিরক্তির ভাব কখনো ফোটে না। আজ ফুটেছে। তিনি টেলিফোন নামিয়ে রেখে ভ্রূ কুঁচকে খানিকক্ষণ ভাবলেন তারপর টেলিফোন করলেন রমনা থানায়। রমনা থানার ওসি বিগলিত গলায় বলল, কেমন আছেন স্যার?
ভালো। আপনার শরীর কেমন?
জ্বি আপনার দোয়া। কিছু করতে হবে?
জ্বি না। একটু ভয় দেখানোর দরকার হয়ে পড়ল যে ও সি সাহেব।
ভয় দেখানোর দরকার হলে দেখাব। হাজতে এনে প্যাদানি দিয়ে দেব। ব্যাপার কি?
ব্যাপার কিছুই না। ক্যাশের টাকা-পয়সার ব্যাপারে একটা ঝামেলা হয়েছে। কয়েকজনকে একটু ভয় দেখানো।
কোনো অসুবিধা নেই। আপনি একটা এফ আই আর করে রাখুন। তার পর দেখুন কি করছি।
না না তেমন কিছু করতে হবে না। ভদ্রভাবে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এতেই কাজ হবে।
বারটার সময় বাবার সঙ্গে দেখা
বারটার সময় বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবার কথা। বুলু যেতে পারে নি। সকাল থেকেই তার গা আগুনে গরম। পায়ে অসহ্য ব্যথা। পায়ের নিচটা কেমন নীল হয়ে গেছে।
বীণা চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকে একটা ধাক্কা খেল। গোঙানীর শব্দ হচ্ছে। বুলুর মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। চোখ ঘোর রক্তবর্ণ। বীণা বলল, কি ব্যাপার দাদা? বুলু বলল,
একটা কুড়াল নিয়ে আয়। কুড়াল দিয়ে কোপ দিয়ে পা-টা কেটে ফেলে দে।
বীণা ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
বাবা অফিসে চলে যাবার পর বুলু শব্দ করে কাঁদতে লাগল। পাড়ার ডাক্তার এসে বলল, এখন হাসপাতালে ভর্তি করেন নি? কী আশ্চর্য! আপনারা এত ক্যালাস কেন? এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যান।
বুলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, নিয়ে গেলেই হাসপাতালে ভর্তি করবে?
চেষ্টা চরিত্র করবেন। আপনাদের চেনা জানা কেউ নেই? দেরি করা উচিত হবে। না। আমার মনে হয় গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে।
বীণা একবার ভাবল বাবাকে অফিসে খবর দেবে। শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলাল না। নিজেই বুলুকে নিয়ে রওনা হল। ফরিদা ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন। বীণার দাদী চেঁচাতে লাগলেন—কে কান্দে রে? বড় বউ না? বড় বউ ক্যালে ক্যান? ও বড় বউ?
লীনা অসম্ভব ভয় পেয়েছে। বাবলুও ভয় পেয়েছে, তবে সে খানিকটা আনন্দিত। কারণ আজ স্কুলে যেতে হবে না। স্কুল তার একেবারেই ভালো লাগে না।
বীণা হাসপাতালে কিছুই করতে পারল না। এখানকার মানুষজন মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে দেখে পাথরের মতো হয়ে গেছে। একটা বয়স্ক ছেলে যে শিশুর মতো চেঁচাচ্ছে তার জন্যে কারো মনে মমতার ছায়া পড়ছে না। শুধু এক জন অল্প বয়স্ক ডাক্তার বীণাকে নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করল। একসময় বলল, আপনি কাঁদবেন না। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
সেই ছেলেও কিছু করতে পারল না। এক সময় লজ্জিত গলায় বলল, আপনার পরিচিত বড় কেউ নেই?
বীণা চোখ মুছতে মুছতে বলল, না। বলেই তার অলিকের কথা মনে পড়ল। ধরা গলায় বলল, আমি কি একটা টেলিফোন করতে পারব?
অবশ্যই পারবেন। আপনি কাঁদবেন না প্লিজ, কাঁদবেন না।
অলিককে পাওয়া গেল। অলিক বলল, ফাচফাচ করে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে ঠাণ্ডা গলায় বল।
বোরহান সাহেব মিটিং-এ ছিলেন।
ছোটখাটো মিটিং না, বড় মিটিং। স্বয়ং মন্ত্রী মিটিং চালাচ্ছেন। এর মধ্যেই বোরহান সাহেবকে বলা হল-বাসা থেকে তাঁর মেয়ে টেলিফোন করেছে। অসম্ভব জরুরি। এক সেকেন্ডও দেরি করা যাবে না। বোরহান সাহেব শুকনো মুখে উঠে দাঁড়ালেন, মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার আমাকে তিন মিনিটের জন্যে একটু ছাড়তে হবে। বাসায় বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়েছে। আমি তিন মিনিটের মধ্যে আসছি। আমি খুবই লজ্জিত।