মিজান সাহেব তুমি তুমি করে বলছেন। প্রচণ্ড রাগের সময় ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তিনি তুমি তুমি করে বলেন।
কাল সাড়ে বারটার সময় তুমি আমার অফিসে আসবে। মনে থাকবে?
জ্বি।
মুখ পরিষ্কার করে আসবে। বাংলাদেশে নাপিতের এখনো অভাব হয় নি। এখন আমার সামনে থেকে যাও।
বুলু চলে যাবার পর-পর মিজান সাহেব বীণাকে ডেকে পাঠালেন। বীণার সঙ্গে তিনি খানিকটা ভদ্র ব্যবহার করলেন। সহজ স্বরে বললেন, বস। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেছ?
বীণা বলল, জ্বি।
সে মনে মনে ঘামতে লাগল। বাবা তার সঙ্গেও তুমি তুমি করে কথা বলছেন।
তুমি কি এম. এ পড়তে চাও?
জ্বি।
কেন চাও?
বীণা জবাব দিল না। মিজান সাহেব বললেন, এম.এ কেন পড়তে চাও সেটা শুনি।
আপনি যদি পড়তে নিষেধ করেন পড়ব না।
মিজান সাহেব বললেন, তোমরা আমাকে কী ভাব বল তো? আমি তোমাকে পড়তে নিষেধ করব কেন?
বীণা দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলছে না।
মিজান সাহেব জবাবের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, তোমাকে একটা ঘড়ি দিয়েছিলাম। প্রথম কিছুদিন সারাক্ষণ হাতে থাকত। এখন একবারও দেখি না। যাও ঘড়িটা নিয়ে আস।
বীণা নড়ল না। আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।
ঘড়িটা কী তোমার সঙ্গে নেই?
না।
কি করেছ, হারিয়ে ফেলেছ?
জ্বি।
না, ঘড়ি তুমি হারাও নি। রাগ করে ফেলে দিয়েছ, কি, আমি ঠিক বলছি না?
বীণা উত্তর দিল না।
মিজান সাহেব বললেন, আচ্ছা তুমি যাও।
তিনি মেয়েকে ডেকেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। বীণার একটা ভালো বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে এই নিয়ে আলাপ করতে চেয়েছিলেন করতে পারলেন না। লজ্জা লাগল। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সহজ নয়। বীণার মার সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করা দরকার। আলাপ করতে ইচ্ছা করছে না। মূৰ্খ মেয়েছেলে। এদের সাথে আলাপ করা না করা সমান। কিছু বললে চারদিকে ঢাক পিটাতে থাকবে। তবু তিনি রাতে শোবার সময় বললেন, বীণার একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।
ফরিদা সঙ্গে-সঙ্গে বিছানায় উঠে বসলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, ছেলে কী করে?
ডাক্তার।
ডাক্তার ছেলে? বল কি? ডাক্তার ছেলে তো খুব ভালো। প্রাকটিস কেমন? রুগী পত্তর পায় তো?
মিজান সাহেব ঘুমুবার আয়োজন করলেন। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে তার আর ভালো লাগছে না। ফরিদা বললেন, ছেলে দেখেছ তুমি?
হুঁ।
দেখতে কেমন?
তিনি জবাব দিলেন না। ফরিদা আবার ক্ষীণ স্বরে বললেন, ছেলে দেখতে কেমন?
মিজান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, দেখতে ভালো। এখন বিরক্ত করো না তো, ঘুমাও।
ফরিদা সারা রাত ঘুমুতে পারলেন না। অল্পতেই তাঁর মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। আজও হয়েছে।
গনি সাহেব বললেন
গনি সাহেব বললেন, কী মিজান সাহেব, আপনাকে এ রকম দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?
জ্বি না।
শরীর খারাপ হলে বাসায় চলে যান। সবারই বিশ্রাম দরকার।
মিজান সাহেব বললেন, আমার স্যার শরীর ঠিক আছে।
তাহলে কি মন খারাপ? মন খারাপ হবার তো কোনো কারণ নেই, ছেলে ফিরে এসেছে।
মিজান সাহেব অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, আমি স্যার গতকাল রহমানের বাসায় গিয়েছিলাম। কথা বলেছি।
বাচ্চাটা ভালো?
জ্বি ভালো।
আর বাচ্চার মা?
সেও ভালো। স্যার আমার ধারণা হিসাবের গণ্ডগোলের সঙ্গে রহমানের কোনো সম্পর্ক নেই।
গনি সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। পরক্ষণেই তা স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন, আপনি কি সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করলেন নাকি?
জ্বি না। তবে তারা টাকাটা কী করে জোগাড় করেছে এটা শুনলাম। খুব কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেছে। জমি জমা, ঘর সব বিক্রি করে একটা বিশ্রী অবস্থা।
আহা বলেন কী!
আমার খুব খারাপ লাগল।
খারাপ লাগারই কথা।
গনি সাহেব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, তাহলে আপনার কী ধারণা? টাকাটা গেল কোথায়? আমার কাছে টাকার পরিমাণ খুবই নগণ্য। ওটা কিছুই না কিন্তু এ রকম একটা ব্যাপার তো হতে দেয়া যায় না, তাই না?
মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন। গনি সাহেব বললেন, ব্যাপারটা ঘটেছে ক্যাশ সেকসনে তাই না?
জ্বি।
রহস্য উদ্ধার হওয়া দরকার। তা নইলে ভবিষ্যতে যে আরো বড় কিছু হবে না তার গ্যারান্টি কি? তাই না?
জ্বি।
পুলিশের হাতে ব্যাপারটা দিয়ে দিলে কেমন হয় বলুন তো? পুলিশ কিছু করতে পারবে না জানা কথা। কখনো পারে না, তবু পুলিশ যদি নাড়াচাড়া করে তাহলে সবাই একটু ভয় পাবে। কি, ঠিক বলছি না?
মিজান সাহেব কিছু বললেন না।
গনি সাহেব বললেন, আমার চিটাগাং ব্রাঞ্চের একটা খবর আপনাকে বলি। ফরেন কারেন্সিতে এগার লাখ টাকার একটা সমস্যা। আমার সবচে বিশ্বাসী যে মানুষটা চিটাগাং-এ আছে তাকেই সন্দেহ করতে হচ্ছে। বুঝতে পারছেন অবস্থাটা?
মিজান সাহেব বললেন, আমার ওপর কি আপনার কোনো সন্দেহ হয়?
কারো ওপর আমার সন্দেহ হয় না। আবার কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। বিশ্বাস করা উচিতও না। আদমের উপর আল্লাহ বিশ্বাস করেছিলেন। সেই বিশ্বাসের ফলটা কি হল বলুনঃ আদম গন্ধম ফল খায় নি? খেয়েছে। মিয়া বিবি দুজনে মিলেই খেয়েছে। চা খান। চা দিতে বলি। বুঝলেন মিজান সাহেব, যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ সেকসান হল তার হাট। হার্টের ছোট অসুখ ধরা পড়ে না। কিন্তু এই ছোট জিনিস হঠাৎ বড় হয়ে যেতে পারে। যখন হয় ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয়ে যায়। কেউ বুঝতেও পারে না। ঠিক কি না, বলুনঃ নির্বোধ মানুষরা সাধারণত সৎ হয়। এই জন্যে ক্যাশে দরকার নির্বোধ ধরনের লোক। মুশকিল হচ্ছে কি, এই নির্বোধ ধরনের লোকদের আবার অন্যরা সহজেই ব্যবহার করে। কাজেই নির্বোধ ধরনের লোক ক্যাশে অচল। সমস্যাটা দেখতে পারছেন? ভীষণ সমস্যা।