চার টাকা ভাড়া ঠিক করা হয়েছিল। চার টাকা দিয়ে বুলু রিকশা থেকে নামল। তার বেশ লজ্জা করছে। পকেটে দুটা সিগারেট আছে। দুটা সিগারেটের একটা কি সে দেবে রিকশাওয়ালাকে? ব্যাপারটা খুব নাটকীয় হয়ে যায় না?
বুলু খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সিগারেট এগিয়ে দিল। নরম গলায় বলল, নেন ভাই একটা সিগারেট নেন।
রিকশাওয়ালা হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। লোটা খুশি হয়েছে। খুশি নামের ব্যাপারটাও বেশ মজার। এটা একই সঙ্গে অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কাজেই কোনো একটি বিশেষ ঘটনায় একটা মানুষ কতটুকু খুশি হবে তা কোনোদিন বলা যাবে না।
এই রিকশাওয়ালা অসম্ভব খুশি হয়েছে। সে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে হাসি মুখে বলল, কি সিগারেট বানায় আইজ কাইল টেস আর নাই। কী কন ভাইজান? আগে বগলা সিগারেট ছিল একটা টান দিলে জেবনের শান্তি। কী ধাখ! ঠিক কইলাম না। ভাইজান?
জ্বি ঠিকই বলেছেন।
ভাইজানের পায়ে হইল কি?
কাঁটা ফুটছে।
আহা কন কি? আস্তে আস্তে যান।
রাতে বুলু কিছু খেল না।
ক্ষিধে নেই।
এক গ্রাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ল। পায়ের যন্ত্রণা খুব বেড়েছে। মনে হচ্ছে হাসপাতালে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে হবে। হাসপাতালে কী করে ভর্তি হতে হয় কে জানে। কাউকে গিয়ে নিশ্চয়ই বলতে হবে-ভাই আপনাদের এখানে আমি ভর্তি হতে চাই। দয়া করে একটা ব্যবস্থা করে দিন। কিংবা দরখাস্ত করতে হবে। আজকাল একটা সুবিধা হয়েছে দরখাস্ত বাংলায় করলেই হয়। বুলু শুয়ে-শুয়ে দরখাস্তের খসড়া ভাবতে লাগল–
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ,
সবিনয় নিবেদন আমার পায়ে একটি কাঁটা ফুটিয়াছিল। পরবর্তীতে সেই কাঁটার কারণে কিংবা অন্য কোনো জটিলতার কারণে পা ফুলিয়া কোলবালিশ হইয়া গিয়াছে। অতএব আপনাদের হাসপাতালে যদি অনুগ্রহপূর্বক আমাকে ভর্তি করিয়া আমার পায়ের একটা গতি করেন তাহা হইলে বড়ই আনন্দিত হইব।
অসুখের সময়টা বেশ অদ্ভুত। আজে-বাজে জিনিস নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। বুলু শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন কায়দায় হাসপাতালের চিঠি নিয়ে ভাবতে লাগল। চলিত ভাষায়, সাধু ভাষায়, বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে আবার বেশ রসিকতা করে। রসিকতার চিঠিটা ভালো আসছে না। শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে রস করা বেশ কষ্ট। তবু কুলু প্রাণপণ চেষ্টা করছে,
হাসপাতালের প্রিয় ভাইয়া,
ভাইজান আপনি কেমন আছেন? আমার পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছে ভাইজান। সংস্কৃতে যাকে বলে কন্টক। আচ্ছা ভাইজান এই কাঁটাটা কী তোলা যায়? কাঁটা তুলতে হয় কাঁটা দিয়ে। আপনাদের কাছে কি কাঁটা আছে?
বীণা ঘরে ঢুকল। কোমল গলায় বলল, দাদা ঘুমুচ্ছ নাকি?
না।
দুধ এনেছি তোমার জন্যে।
দুধ খাবারে।
বীণা ভাইয়ের মাথায় হাত রাখল। গায়ে অনেক জ্বর তবু সে কোমল গলায় বলল, জ্বর তো নেই।
বুলু বলল, নেই তবে আসব আসব করছে।
বীণা ভাইয়ের পাশে বসল। তার ভাব-ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়।
বুলু বলল, কিছু বলবি?
না।
তাহলে বসে থাকি না। তোকে দেখে বিরক্তি লাগছে।
বীণা বসেই রইল।
বুলু বলল, যদি কিছু বলার থাকে বলে চলে যা বীণা। এরকম পাথরের মতো মুখ। করে বসে থাকবি না। চড় মারতে ইচ্ছা করছে।
তোমার একটা চিঠি আমার কাছে আছে দাদা। কিন্তু চিঠিটা তোমাকে দিতে ইচ্ছা করছে না।
কার চিঠি?
অলিকের চিঠি। ওর মাথার ঠিক নেই, কী লিখেছে সে নিজেও বোধ হয় জানে না।
তুই চিঠি পড়েছিস?
হ্যাঁ। খোলা চিঠি দিয়েছে পড়ব না কেন?
আমাকে সেই চিঠি তোর দিতে ইচ্ছে করছে না?
না।
তাহলে দেয়ার দরকার নেই।
ঐ চিঠি পড়লে মেয়েটা সম্পর্কে তোমার ধারণা খারাপ হতে পারে। আমি সেটা চাই না। ও খুব ভালো মেয়ে।
ঠিক আছে চিঠি দিতে হবে না।
ওর সঙ্গে যদি কোনোদিন তোমার দেখা হয় তাহলে তুমি কিন্তু বলবে চিঠি পেয়েছ।
আচ্ছা বলব। এখন তুই দয়া করে বিদেয় হ।
বাবা তোমাকে ডাকছেন দাদা।
বলিস কি?
সন্ধ্যাবেলা তোমার খোঁজ করেছিলেন—তুমি ছিলে না।
বুলু উঠে বসল। নিচু গলায় বলল, বাবা কী করছেন?
খাতাপত্র নিয়ে বসেছেন।
এখন যাব?
যাও।
ভয় ভয় লাগছে। ফেল করার পর এখন পর্যন্ত সিরিয়াস কিছু বলেন নি। আজ বোধ হয় বলবেন।
বীণা কিছু বলল না। বুলু বলল, আমি কী বলব বল তো?
বীণা বলল, তুমি কিছুই বলবে না। চুপচাপ শুনবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাবা কিছুই বলবেন না।
মিজান সাহেব তাঁর ঘরে। বিছানায় কাগজপত্র ছড়িয়ে বসেছেন। তাঁর হাতে একটা ক্যালকুলেটর। বুলুকে দেখে মুখ তুলে তাকালেন। বুলু বলল, আমাকে ডেকেছিলেন?
মিজান সাহেব কিছু বললেন না। এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন ছেলেকে চিনতে পারছেন না। তারপর চোখ নামিয়ে ক্যালকুলেটরের ফিগার দেখে কাগজে লিখলেন। আবার কয়েকটা সংখ্যা টিপলেন। বুলুর ধারণা হল বাবা তার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে এখন আর আগ্রহী নন। সে চলে যাবে, না আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। তার কাশি আসছে অথচ কাশতে সাহস হচ্ছে না। কাশি চাপতে গিয়েও পুরোপুরি চাপতে পারল না। সামান্য শব্দ হল। মিজান সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। ভারী গলায় বললেন, কী করবে কিছু ঠিক করেছ?
বুলু জবাব দিল না।
আবার পরীক্ষা দেবে?
জ্বি।
গাধারাই চারবার বি.এ পরীক্ষা দেয়। তারপর অভ্যাস হয়ে যায়। অভ্যাস হয়ে যাবার পর প্রতিবার একবার করে দেয়।
বুলু চুপ করে রইল।
মিজান সাহেব বললেন, তুমি একটা গাধা। তোমাকে দেখে যে কেউ একটা গাধার রচনা লিখতে পারে। মুখ ভর্তি দাড়ি কেন? গাধার মুখে দাড়ি কখনো দেখেছ?