পায়ের ব্যথা বড়ই বাড়ছে। পা শরীরেরই অংশ অথচ মনে হচ্ছে এটা শরীরের অংশ না। পা বিদ্রোহ করে বসেছে। কে জানে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হয়ত আলাদা জীবন আছে।
ব্যথা ভুলে থাকার জন্যই বুলু রিকশাওয়ালার সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করল। এই রিকশাওয়ালা তেমন আলাপী না। যাই জিজ্ঞেস করা হয় সে এক অক্ষরে জবাব দিতে চেষ্টা করে।
বুলুর মনে হল—রিকশাওয়ালাদের জীবন বোধ হয় তেমন মন্দ না। তাদেরকে তিন-তিন বার বি.এ ফেল করার যন্ত্রণা পেতে হয় না। এই কষ্টের তীব্রতা সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। যে কোনো শারীরিক কষ্টই সহনীয়। শরীর নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত কষ্ট সহ্য করবে তার চেয়ে বেশি হলে—অজ্ঞান। নিশ্চিন্ত ঘুমের মতো একটা ব্যাপার। তিনবার বি. এ ফেল করে কেউ অজ্ঞান হয় না। হতে পারলে ভালো হত।
বুলু এখন কী করবে?
আবার পরীক্ষা?
কোনো মানে হয় না।
চাকুরি?
চাকুরি তাকে কে দেবে? পিওনের চাকরির জন্যেও আজকাল এম.এ পাশ ছেলে দরখাস্ত করে বসে। ঐদিন পত্রিকায় দেখছিল স্টোর কিপারের একটা চাকরির জন্যে একুশ জন এম.এ পাশ ছেলে দরখাস্ত করেছে। তিন জনের আছে এম ফিল ডিগ্রি। অথচ চাওয়া হয়েছে ম্যাট্রিক পাশ ছেলে।
সে নিজেও একবার ইন্টার দিয়েছিল। সরকারি চাকরির ইন্টার। ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশনে প্রুফ রিডার। তার ইন্টারভ্যুর সিরিয়াল হল ১৪০৩। চার দিন ধরে ইন্টারভ চলছে। সে পঞ্চম দিনে বোর্ডর সামনে ঢুকল। বোর্ডের চার জন মেম্বার। চার জনেরই বিধ্বস্ত অবস্থা। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই চার জন একসঙ্গে পাগল হয়ে যাবে।
বুলু অনেকক্ষণ তাদের সামনে বসে রইল কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। বুড়ো এক ভদ্রলোক তার পাশের ভদ্রলোককে বললেন, কিছু জিজ্ঞেস করুন। সে মহাবিরক্ত হয়ে বলল, আপনি করুন না কেন? আপনার অসুবিধাটা কী? অপেক্ষাকৃত কম বয়সের এক জনকে দেখা গেল তার সামনে রাখা প্যাডে কী সব ডিজাইন আঁকছে। এবং মুখ বিকৃত করে চোখের সামনে ধরছে। বড় মায়া লাগল বুলুর। এই লোগুলো দিনের পর দিন ইন্টার নিয়ে যাচ্ছে। আরো কত দিন নেবে কে জানে। তাদের মনে এখন হয়ত কোনো প্রশ্নই আর আসছে না। এরা নিশ্চয়ই রাতেও ইন্টারন্যূর দুঃস্বপ্ন দেখছে।
বুলু বলল, স্যার আমি তাহলে যাই?
এই কথায় বোর্ডের সবার মধ্যেই যেন আনন্দের একটা হিল্লোল বয়ে গেল। বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা বাবা যাও।
ডিজাইন যে করেছিল সেও এই প্রথমবারের মতো প্রসন্ন মুখে তার ডিজাইনের দিকে তাকাল।
আজকাল ব্যবসা কথাটা খুব চালু হয়েছে। পাশ করেই ছেলেরা ব্যবসায় নেমে পড়ছে। ব্যবসা কীভাবে করতে হয় বুলু জানে না, শুধু একটা জিনিস জানে। ব্যবসা করতে টাকা লাগে। আচ্ছা বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবসা কি আছে যেখানে টাকা লাগে না? বুলুদের মতো ছেলেদের জন্যে এই জাতীয় কিছু ব্যবসা থাকলে মন্দ হত না।
রিকশার কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। বার-বার চেইন পড়ে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা তিক্ত বিরক্ত হয়ে কোত্থেকে একটা ইট এনে শব্দ করে কিসে যেন খানিকক্ষণ পেটাল। তাতেও লাভ হল না। আবার চেইন পড়ে গেল। রিকশাওয়ালা কর্কশ গলায় বলল, হালার রিকশা। বুলুর ইচ্ছা হল রিকশাওয়ালাকে বলে—ভাই তোমার কোনো দোষ নেই, দোষ আমার। আমাকে রিকশায় তুলেছ বলে এই অবস্থা। আমাকে না তুলে অন্য কাউকে তুললে এতক্ষণ পৌঁছে যেতে। বেচারা রিকশাওয়ালা রিকশার হাতল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বুলু বলল, ভাই আমার পায়ের অবস্থা খারাপ নয়ত হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম। রিকশাওয়ালা জবাব দিল না। কি যেন বিড় বিড় করে বলল। সম্ভবত সেও তার ভাগ্যকে গালাগালি করছে।
ভাগ্য বেচারার জীবন গেল গালি খেয়ে। এই পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছে যে তার ভাগ্যকে গালি দেয় না? সবাই দেয়।
বুলু তার চিন্তার স্রোত বদলাতে চেষ্টা করল। এক খাত থেকে চিন্তাটা অন্য খাতে নিয়ে যাওয়া। ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। চিন্তা নদীর স্রোতের মতো। এর গতি বদলানো কঠিন তবে বুল পারে। দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে এটা সম্ভব হয়েছে। সে ভাবতে শুরু করল—একটা নতুন ধরনের গ্রহের কথা। যে গ্রহটা অবিকল পৃথিবীর মতো। মানুষগুলোও পৃথিবীর মানুষের মতো। তবে তাদের জীবনে অনেকগুলো ভাগ আছে। সেই গ্রহে সবারই কিছু সময় কাটে দারুণ সুখে, কিছুটা দুঃখে, কিছুটা জেলখানায়, কিছুটা দেশ-বিদেশ ঘুরে। সব রকম অভিজ্ঞতা শেষ হবার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, হেমানব সন্তান তোমার জীবনে কোনো অপূর্ণ বাসনা আছে? যদি সে বলে—হ্যাঁ আছে। তাহলে তাকে সেই বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ দেয়া হয়। যতদিন না তার সমস্ত বাসনা পূর্ণ হয় ততদিন তার মৃত্যু নেই।
বুলুর কল্পনায় অনেক ধরনের পথিবী আছে। সুন্দর পৃথিবীর মতো কসিত পৃথিবীও আছে। সেই পৃথিবীর সব মানুষই নোংরা ও কদাকার। হৃদয়ে ভালবাসা বা মমতা বলে কিছু নেই। যা আছে তার নাম ঘৃণা। সেখানকার সব মানুষ পঙ্কিল জীবন যাপন করে। সেই পৃথিবীতে কোনো চাঁদ নেই। রাতের স্নিগ্ধতা নেই। সব সময় সেই পৃথিবীর আকাশে দুটি গগনে সূর্য।
স্যার নামেন।
বুলু নামল। রিকশাওয়ালা দরদর করে ঘামছে। শরীরের সমস্ত পানি ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসছে। টাকা থাকলে বুলু এই বেচারাকে একটা ঠাণ্ডা পেপসি খাওয়াত। টাকা নেই। আচ্ছা, রিকশাওয়ালাদের গায়ের ঘাম নিয়ে কি কোনো কবিতা আছে? একটা চমৎকার কবিতা কি লেখা যায় না? যেমন রিকশাওয়ালার গায়ের ঘাম শুকিয়ে শরীরে লবণের পর্দা পড়েছে। যা দেখাচ্ছে দুধের সরের মতো।