মিজান সাহেব যতটা আশা নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন তার কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনোরকম উন্নতি তিনি করতে পারেন নি। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পর লবণ এবং পেঁয়াজের ব্যবসা করে কিছু টাকা করেছিলেন, সেই টাকায় বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় একটা ঘর তোলা শুরু করেছিলেন। ছাদটলাই হবার আগেই কাজ বন্ধ হয়ে গেল। চিটাগাং থেকে বুক করা দুই ওয়াগন লবণ আখাউড়া পর্যন্ত এসে উধাও হয়ে গেল। কত ছোটাছুটি, কত লেখালেখি, উকিলের চিঠি, একে ধরা, তাকে ধরা। লাভ হল না। দেশে আইন-কানুন নেই। যার যা ইচ্ছা করছে। সে অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত।
এক বন্ধুর সঙ্গে কিছুদিন কন্ট্রাক্টারি করলেন। এ দেশে কন্ট্রাক্টারি করে মানুষ ধনবান হয়। তিনি হলেন নিঃস্ব। সেই বন্ধুর কল্যাণে জেলে যাবার উপক্রম হয়েছিল। পৈত্রিক জমি-জমা বিক্রি করে অনেক কষ্টে তা ঠেকালেন।
মা বাবাকে দেশের বাড়ি থেকে উঠিয়ে এখানে এনে রাখলেন। তাঁর বাবা দেশের বাড়িতে সুখেই ছিলেন। এখানে এসে বড়ই অসহায় হয়ে পড়লেন। বেশিরভাগ সময় কুয়াতলায় বসে থাকতেন। যখন তখন চিকন গলায় বলতেন, কোনহানে আনলিরে মিজান? ও বাপধন কোনহানে আইন্যা ফেললি? দম বন্ধ হইয়া যায়। খোলা বাতাস নাই।
মিজান তিক্ত গলায় বলতেন, খোলা বাতাস, খোলা বাতাসের দরকারটা কি তোমার?
জানটা খালি শুকাইয়া আহে।
বড় যন্ত্রণা করছ বাবা তুমি। বড়ই যন্ত্ৰণা করছে।
মিজান সাহেবের বাবা দীর্ঘদিন যন্ত্রণা দিলেন না। ভাদ্র মাসের এক দপুরে হঠাৎ করে মরে গেলেন। তবে মেয়েদের জীবন বেড়ালের জীবনের মতো। কিছুতেই সে জীবন বের হতে চায় না। মিজান সাহেবের মা বেঁচে রইলেন। তিনি চোখে এখন প্রায় দেখতেই পান না। বোধ শক্তিও নেই। গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না। মিজান সাহেবের সবচে ছোট ছেলে বাবলু কোনো কোনো দিন দাদীর ঘরে ঢুকে চেচিয়ে ওঠে, দাদী নেংটা, ছি ছি দাদী নেংটা।
পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাবাবলুর চেয়েও উঁচু গলায় চেঁচান, মর হারামজাদা মর। বদের বদ। শয়তানের শয়তান। মর তুই মর। এই জাতীয় গালি শুনলে সব সময় ফরিদার গা কাঁপে তবে তাঁর শাশুড়ির গালিতে তিনি খুব একটা বিচলিত হন না। কোথায় যেন শুনেছেন রক্ত সম্পর্কের মুরবী যদি মর-মর করে গালি দেয় তাহলে আয়ু বাড়ে।
পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাও বাড়ির সকলের আয়ু ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেন। শুধু মানুষ না জীব-জন্তু, পশু-পাখির আয়ুও তিনি বাড়ান। একটা কাক হয়ত ডাকছে কাকা। তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গালি দেবেন, মর হামজাদা মর। ভাত খাবার সময় পাশ দিয়ে একটা বেড়াল গেল, তিনি চেঁচাবেন, মর হারামজাদা বিলাই। তুই মর।
মিজান সাহেবের মাঝে-মাঝে অসহ্য বোধ হয়। তিনি তীব্র গলায় বলেন, চুপ। তাঁর মা তার চেয়েও উঁচু গলায় বলেন, তুই চুপ। হারামজাদা ছোড লোক। আমারে বলে চুপ। মুর হারামজাদা।
মিজান সাহেবের সত্যি-সত্যি মরতে ইচ্ছা করে। সংসার বড় হচ্ছে। তিনি সামাল দিতে পারছেন না। মাঝে-মাঝে রাতে তাঁর একেবারেই ঘুম হয় না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন। মাথার দুপাশের রগ দপদপ করে। সত্যি-সত্যি তিনি যদি মরে যান তাহলে এই সংসারটার কী হবে এটা ভাবলে শরীর অবশ হয়ে আসে। তাঁর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না, তবু শুধু সংসারের জন্যে তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে এই চিন্তা তাঁকে কাবু করে ফেলে। তাঁর অসহ্য বোধ হয়। অসহ্য বোধ হলেও তিনি ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মে প্রতিদিন তাঁর জীবন শুরু করেন। বাজার করেন, অফিসে যান, অফিস থেকে ফিরে মার ঘরে উঁকি দিয়ে বলেন, কেমন আছ মা? আজ শরীরটা কেমন? বৃদ্ধা তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, মর হারামজাদা। রোজ ঢং করে।
মিজান সাহেব বর্তমানে মেঘনা এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেডের ক্যাশিয়ার। এই প্রাইভেট কোম্পানির অনেকরকম ব্যবসা ট্রান্সপোর্ট, ইন্ডেন্টিং, কেমিক্যালস এবং হোটেল। মিজান সাহেবের হাত দিয়ে রোজ যে পরিমাণ টাকার লেন-দেন হয় তা দেখে তিনি বিস্ময় বোধ করেন। দেশের কিছু কিছু মানুষের হাতে এত টাকা কী করে চলে আসছে তিনি তা ভেবে পান না। মেঘনা এন্টারপ্রাইজেসের মালিক-ওসমান গনি। হোট-খাটো মানুষ। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে। থুতনীতে অল্প কিছু দাড়ি। ধবধবে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দেন। চোখে সামান্য সুরমা দেন। রিভলভিং চেয়ারে পা তুলে বসেন। ঘন-ঘন পান খাওয়া ছাড়া তাঁর অন্য কোনো বদ অভ্যাস নেই। গলার স্বর খুবই মোলায়েম। ব্যবহারও ভদ্র। অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হলে তিনি সবার আগে বলেন, স্লামালিকুম। চড়া গলায় কারো সঙ্গে একটা কথাও বলেন না। তবু সবাই তাঁর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। এই ভয়ের উৎস গনি সাহেবের ব্যক্তিত্ব নয়—ক্ষমতা। ক্ষমতা বড়ই শক্ত জিনিস।
গনি সাহেবের কয়েকটি অফিস আছে। প্রতিটি অফিসে তাঁর একজন প্রিয়পাত্র আছেন। এই সব প্রিয়পাত্রদের প্রতিদিনই তিনি কিছুটা সময় দেন। নিজের কামরায় ডেকে নিয়ে গিয়ে নানান গল্প করেন। অন্যদের সঙ্গে তিনি কী গল্প করেন কে জানে কিন্তু মিজান সাহেবের সঙ্গে গল্পের বিষয়বস্তু একটাই। তা হচ্ছে—গনি সাহেবের বয়স হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো একদিন মরে যাবেন। মরবার আগে দেশের জন্যে তিনি কিছু করতে চান। টোটকা-ফাটকা কিছু না। স্থায়ী কিছু। গনি সাহেব, মধুর স্বরে জানতে চান—কী করা যায় বলুন দেখি মিজান সাহেব? স্কুল-কলেজের কথা আমাকে বলবেন না। এই জাতিকে লেখাপড়া শিখিয়ে কিছু হবে না। অন্য কিছু ভাবুন। চট করে বলার দরকার নেই। চিন্তা ভাবনা করুন। আমি নিজের কোনো নাম চাই না। আমি চাই টাকাটা কাজে লাগুক। বুঝতে পারছেন?