মিজান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বীণার বন্ধু—এক রাত থাকবে আমি তাতে রাগ করব কেন? কি বলছ এসব? ফরিদা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন।
ডাক মেয়েটাকে।
ফরিদা অলিককে ডাকতে যাচ্ছিলেন, মিজান সাহেব বললেন, থাক পরে কথা বলব। খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা করেছ?
কিছু তো ঘরে নাই।
কিছু একটা কর। বীণার যেন মনটা ঘোট না হয়। ও এমন মুখ কালো করে ঘুরছে কেন?
ভয় পাচ্ছে—তুমি যদি কিছু বল।
আমি কিছু বলব কেন? আমার মেয়ের এক বন্ধু এক রাত আমার বাসায় এসে থাকতে পারবে না? এতে আমি রাগ করব? এরা আমাকে ভাবে কী?
মিজান সাহেব বড়ই বিরক্ত হলেন। বুলুকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠালেন। যদি কিছু পাওয়া যায়।
নিজেই গিয়ে দৈ কিনে আনলেন। বারান্দায় পাটি পেতে খাবার ব্যবস্থা হল। মিজান। সাহেবের ইচ্ছা-সবাই যেন এক সঙ্গে বসে। অলিক খুবই সহজভাবে মিজান সাহেবের পাশে এসে বসল এবং হাসি মুখে বলল, চাচা এরা সবাই আপনাকে এত ভয় পায়। কেন বলুন তো? আপনার দুপাশের দুটি থালা বাদ দিয়ে সবাই বসেছে। এরা এত ভয় পায় আপনাকে, আপনার খারাপ লাগে না?
মিজান সাহেব সকলকে অবাক করে দিয়ে বললেন, খারাপ লাগে মা। খুবই খারাপ লাগে। বীণা, তুই আয়, আমার এই পাশে বোস।
বীণা জড়সড় হয়ে বাবার পাশে এসে বসল। মিজান সাহেব অলিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আরেকদিন এসে এখানে থাকবে মা, কেমন? আজ তোমাকে শুধু ভাত খেতে হল। আমি খুবই লজ্জিত।
রাতটা ছিল চমৎকার।
আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। লক্ষ লক্ষ তারা ফুটেছে। চমৎকার বাতাস। দুই বান্ধবী কুয়া তলায় বসে গল্প করছে। গল্প অবশ্যি করছে অলিক, শুনছে বীণা।
বুঝলি বীণা, কবিতা লেখা বাদ দিয়ে আমি একটা বড় গল্প লিখব বলে ভাবছি। সেই বড় গল্পটাই তোকে শোনাতে এসেছি। গল্পের শেষটা কী হলে ভালো হয়। সেটাই বুঝতে পারছি না।
গল্পটা শুরু হচ্ছে আমার মতো বয়েসী একটা মেয়েকে নিয়ে। চমৎকার একটি মেয়ে, রূপবতী, ইন্টেলিজেন্ট, ফুল অব লাইফ। হঠাৎ মেয়েটা জানতে পারল তার ভয়াবহ একটা অসুখ হয়েছে। তার আয়ু আছে ছমাসের মতো। শুরুটা কেমন রে?
খুব সাধারণ, লক্ষ লক্ষ এ রকম গল্প আছে। খুব ট্রাজিক শুরু।
আমার গল্পটা অন্য গল্পের মতো না। আমার গল্পের মেয়েটা ছমাস আয়ুর ব্যাপারটা বেশ সহজভাবে নিল। ঠিক করল জীবনটা মোটামুটি যতটুকু পারে ভোগ করবে। মেয়েটির কোনো যৌন অভিজ্ঞতা নেই অথচ ব্যাপারটা কী তা সে জানতে চায়……।
বীণা বলল, কি সব আজে-বাজে কথা শুরু করলি। চুপ কর তো।
এটা আজে-বাজে হবে কেন? সারা পৃথিবী জুড়ে যে জিনিসটা নিয়ে এত মাতামাতি, মানুষের এত আগ্রহ, এত কৌতূহল সেইটা যদি একটা মেয়ে মরবার
আগে জেনে যেতে চায় তাতে দোষের কী?
একটা শালীনতার ব্যাপার আছে না?
যে মেয়ে দদিন পর মরে যাচ্ছে তার আবার শালীনতা কি?
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, তুই তোর গল্প বল।
এখন মুশকিল কি হয়েছে জানিস? মুশকিল হচ্ছে মেয়েটা তার এই কৌতূহল কী ভাবে মেটাবে বুঝতে পারছে না। সে তো আর কোনো এক জনকে বলতে পারে না ভাই আজ রাতে আপনি দয়া করে আমার সঙ্গে ঘুমুবেন?
বীণা হেসে ফেলল।
অলিক বলল, বাইরে থেকে মেয়েটাকে যথেষ্ট স্মার্ট মনে হলেও আসলে সে লাজুক ধরনের একটা মেয়ে এবং খুব ভালো মেয়ে।
বীণা বলল, এই তোর গল্প?
হুঁ।
গল্প তাকে দিয়ে হবে না। তুই বরং কবিতাই চালিয়ে যা।
অলিক দীৰ্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
বীণা বলল, তুই এমন মন খারাপ করে ফেললি কেন?
বুঝতে পারছি না। মাঝে-মাঝে আমার এরকম হয়। অল্পক্ষণের জন্যে মন খারাপ হয়। তার হয় না?
বীণা হেসে বলল, আমার বেশিরভাগ সময়ই মন খারাপ থাকে। মাঝেমাঝে মন ভালো হয়। আমরা দুজন সম্পূর্ণ দরকম।
অলিক বলল, এসব কচকচানি বাদ দে, আয় একটা কবিতা শোন।
তোর লেখা?
না ডাবলিউ মরিখের লেখা। অসাধারণ।
He did not die in the night,
He did not die in the day,
But in the morning twilight
His spirit passd away,
When neither sun nor moon was bright,
And the tree were merely grey.
বুলুর পা কিছুতেই সারছে না
বুলুর পা কিছুতেই সারছে না। আজ পায়ের যন্ত্রণায় তার জ্বর এসে গেল। গ্রিন ফার্মেসির ডাক্তার এক গাদা এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন—ভেতরে কাঁটা রয়ে গেছে। বোধ হয়। কেটে বের করতে হবে। আপনি বরং কোন একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। বুলু অবাক হয়ে বলল, সামান্য কাঁটা ফুটার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হব?
কাঁটাটা বের করা দরকার না? পা নিয়ে এতদিন কষ্ট করছেন। এর কোনো মানে হয়?
কোনোই মানে হয় না তবু কুলু তার অচল পা নিয়েই আদাবরে চলে গেল। আজ বুধবার টিউশ্যানির টাকাটা যদি আদায় হয়। ছাত্রের বাবা বিরক্ত মুখে দেখা দিলেন। শুকনো গলায় বললেন, ও আচ্ছা আপনি? বাসায় অনেক গেস্ট। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না মাস্টার সাহেব। বিয়ের একটা আলাপ চলছে। আপনি এক কাজ করুন, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে চলে আসুন।
বুলু ভেবেই পেল না বিয়ের আলাপের সঙ্গে তার বেতনের সম্পর্কটা কী? অনেক কষ্টে সে অর্ধেক পথ হেঁটে শেষ পর্যন্ত রিকশাই নিয়ে নিল। পকেটে শেষ সম্বল চারটা টাকা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে দিতে হবে এই দুঃখে তার প্রায় কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। তিন বার বি.এ ফেল করা ছেলে হাত খরচের টাকা চাইতে পারে না। চাওয়া সম্ভব নয়।