অলিকের মনে আছে বীণাদের বাড়ি একতলা। বাড়িতে চমৎকার একটা কুয়া আছে। কুয়ার পাড়ে একটা ফুলের গাছ। ফুল গাছের নাম মনে নেই, তবে সাদা রঙের ফুল যার গন্ধ খুবই হালকা।
অলিক এক ঘন্টার মতো হাঁটাহাঁটি করল। এক ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করেও সে তেমন ক্লান্তি বোধ করছে না। বরং মজাই লাগছে। এক ধরনের চ্যালেঞ্জ বোধ কাছে। সে ঠিক করে ফেলল সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত সে খুঁজবে। সূর্য ড়ুবে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে উকিল সাহেবের বাসায় যাবে। তাঁর সুন্দরী মেয়েগুলোকে দেখে সেই বাসা থেকেই বাবাকে টেলিফোন করে বলবে গাড়ি পাঠাতে। উকিল যখন, তখন নিশ্চয়ই বাসায় টেলিফোন আছে।
অলিককে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না—তার আগেই গুণ্ডামতো মুখ ভর্তি দাড়ি গোফওয়ালা এক ছেলে এসে বলল, আপনি নাকি বীণা নামের একটা মেয়েকে খুঁজছেন।
অলিক বলল, আপনাকে কে বলল?
চায়ের দোকানে শুনলাম। আসুন আমার সঙ্গে।
আপনার সঙ্গে যাব কেন? আপনাকে দেখে গুণ্ডা বলে মনে হচ্ছে।
দাড়িওয়ালা লোকা হেসে বলল, আমি বীণার বড় ভাই। আমার নাম বুলু।
আপনি যে তার ভাই তারই বা প্রমাণ কি?
মুখে দাড়ি না থাকলে চিনতে পারতেন। আমরা সব ভাইবোন দেখতে এক রকম।
বীণা বাসায় আছে?
জ্বি আছে।
উকিল সাহেবের বাসা কোনটা জানেন?
কোন উকিল সাহেবের বাসা?
যার অনেকগুলো রূপবতী মেয়ে আছে।
জানি না তো।
সে কী, আপনি জানেন না? সবাই তো জানে। আসুন আমার সঙ্গে। আমি চিনি। ঐ বাসায় খানিকক্ষণ বসে তারপর আপনার সঙ্গে যাব।
বুলু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই ধরনের একটি মেয়ের সঙ্গে বীণার পরিচয় আছে এটা ভাবতেই তার অবাক লাগছে। বুলু মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল।
আপনি মুখ ভর্তি দাড়ি রেখেছেন কেন?
বুলু হাসতে হাসতে বলল, পরীক্ষায় ফেল করে দাড়ি রেখে ফেলেছি।
পরীক্ষায় ফেল করলে দাড়ি রাখতে হয় জানতাম না তো। ইন্টারেস্টিং। আপনারা না হয় দাড়ি রাখলেন। আমরা মেয়েরা কী করব? আমাদের তো দাড়ি রাখার উপায় নেই।
চুল কেটে ফেলতে পারেন।
মন্দ না। আপনি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেন। আপনার বাঁ পাটা কি শর্ট?
বাঁ পায়ে কাঁটা ফুটেছে।
কাঁটা তো গলায় ফোটে জানতাম। পায়েও ফোটে।
হ্যাঁ ফোটে।
আপনি খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করেন নাকি?
বুলুর ধারণা হল মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। এক জন সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে এরকম অনর্গল কথার পিঠে কথা এক জন অপরিচিত ছেলের সঙ্গে বলবে না। আশ্চর্য, এমন মজার একটি মেয়েকে বীণা চেনে অথচ কোনোদিন এই মেয়েটার কথা সে তাদের বলে নি।
উকিল সাহেব বা উকিল সাহেবের মেয়েদের কাউকেই পাওয়া গেল না। গেটে বিরাট তালা।
অলিক বলল, চলুন যাওয়া যাক। আপনাদের বাসা কি অনেকখানি দূর?
না, দূর না, কাছেই। ঐ যে চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে, ওর পেছনে।
আরো একটু দূর হলে ভালো হত, কথা বলতে বলতে যাওয়া যেত। আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
বুলু হকচকিয়ে গেল। এই পাগল মেয়ে বলে কি? অলিক হাসি মুখে বলল, আপনি এত ঘাবড়ে গেলেন কেন? মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা আপনার অভ্যেস নেই তাই না? আমার সামান্য কথা শুনেই আপনার ধারণা হয়েছে আমি আপনার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছি। শুনুন আপনাকে একটা জরুরি কথা বলি। কুড়ি পার হওয়া মেয়েরা খুব হিসেবী, তারা চট করে কারো প্রেমে পড়ে না। দাড়ি গোফের জঙ্গল হয়ে আছে এমন ছেলেকে তো নয়ই।
বুলু স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি চাইলে আমি দাড়ি গোফ কামিয়ে ফেলতে পারি।
অলিক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আশেপাশের সবাইকে সচকিত করে খিল। খিল শব্দে হেসে উঠল। অনেকদিন এমন গাঢ় আনন্দে সে হাসে নি।
ভালো কথা আপনি শিমুল গাছের ইংরেজি কী জানেন?
জ্বি না। আমি কোনো গাছের ইংরেজিই জানি না। শুধু জানি গাছ হচ্ছে ট্রি।
শিমুল গাছের ইংরেজি হচ্ছে Cotton seed tree. আপনি কি শিমুল গাছ দেখেছেন?
দেখব না কেন? আমার পায়ে যে কাঁটা ফুটেছে সেটা হচ্ছে শিমুল কাঁটা।
কী বললেন?
শিমুল কাঁটা ফুটে আমার অবস্থা কাহিল।
বাহ্ চমৎকার তো। কী আশ্চর্য যোগাযোগ।
বুলু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটির কথাবার্তা সে কিছুই বুঝতে পারছে। না।
ফরিদা খুবই বিব্রত বোধ করছেন ঘরে রাতে তেমন কিছুই রান্না হয় নি। দুপুরের ইলিশ মাছের তরকারি সামান্য ছিল ঐ দিয়েই টেনে টুনে রাতটা পার করে দেবেন। ভেবেছিলেন—এখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। বীণা এক ফাঁকে এসে বলে গেছে, মা, ও রাতে এখানে থাকতে চায়।
ফরিদা বিস্মিত হয়ে বললেন, রাতে থাকার দরকার কি?
থাকতে চাচ্ছে, এখন কী করে বলি থাকা যাবে না।
থাকার দরকারটা কি?
ওর মাথার ঠিক নেই মা?
এ রকম মাথা খারাপ মেয়ের সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব হল কী ভাবে?
ও খুব ভালো মেয়ে মা। ওর সঙ্গে ভালো করে না মিশলে তুমি বুঝবে না।
আমার এত বোঝার দরকার নেই। এখন তোর বাবা এসে কী করে সেইটাই হচ্ছে কথা। চেঁচামেচি না করলেই হল। ও ঘুমুবে কোথায়?
ও বলছে ঘুমুবে না। কুয়ার পাড়ে বসে সারা রাত গল্প করবে।
মেয়েটা কি সত্যি-সত্যি পাগল নাকি?
ফরিদা মেয়েটিকে ঠিক অপছন্দ করতে পারছেন না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মিশছে। যেন এটা তার নিজের বাড়ি।
রাত আটটার দিকে মিজান সাহেব বাড়ি ফিরে অবাক হয়ে লক্ষ করলেন ফুটফুটে একটা মেয়ে বীণার শাড়ি পরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসু চোখে ফরিদার দিকে তাকাতেই ফরিদা হড়বড় করে বললেন, বীণার বন্ধু, মেয়েটার মা নেই। খুব দুঃখী মেয়ে। আজ রাতটা বীণার সঙ্গে থাকতে এসেছে। তুমি রাগারাগি করবে না।