বোরহান সাহেব বললেন, ভাই ভালো করে দেখুন।
ভালো করেই দেখেছি। এইসব ফাংগাসরা অনেক জায়গায় বংশ বিস্তার করতে পারে। মানুষের চামড়া তাদের বংশ বিস্তারের জন্যে ভালো জায়গা। আমি একটা মলম দিচ্ছি গোসলের পর চামড়ায় লাগাতে হবে।
অলিক বলল, লাগালেই সেরে যাবে?
অবশ্যই সারবে।
কতদিন লাগবে সারতে?
এই ধর সাত দিন। দাগ পুরোপুরি মেলাতে দশ পনের দিন লাগতে পারে।
অলিক বলল, আপনি কি ভালোমতো দেখেছেন ডাক্তার সাহেব?
প্রফেসর বড়ুয়া খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন। এক জন এম আর সি পি ডাক্তারকে ঘন ঘন যদি বলা হয় আপনি কি ভালোমতো দেখেছেন তাহলে খুব সঙ্গত কারণেই তাঁর রাগ হবার কথা।
বোরহান সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মা তুমি একটু বাইরে যাও আমি উনার সঙ্গে একটু কথা বলব।
অলিক বলল, আমার সামনেই বল। তোমার এমন কোনো কথা নেই যা আমার সামনে বলা যাবে না। মার কথাই তো তুমি বলবে তাই না?
হ্যাঁ।
বল। আর তোমার যদি বলতে অস্বস্তি লাগে তাহলে না হয় আমিই বলি।
বোরহান সাহেব চুপ করে গেলেন। স্ত্রীর প্রসঙ্গে কথা বলতে আসলেই তাঁর অস্বস্তি হচ্ছে। অলিক খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বেশ সহজভাবেই বলল, ডাক্তার সাহেব আমার মায়ের চামড়াতেও ঠিক একই রকম হলুদ রঙের দাগ হয়েছিল, তারপর সেগুলো হয়ে গেল কালচে। এখানকার ডাক্তাররা বললেন কিছুই না—এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণ। ওষুধ দিলেন। কিছুই হল না। ওষুধ বদলানো হল—কিছুই না, দাগ বাড়তে লাগল, শুরু হল যন্ত্ৰণা। মাকে আমরা বিলেত নিয়ে গেলাম। সেখান থেকে আমেরিকার জন হপকিন্স হাসপাতালে। ডাক্তাররা বললেন—এটা একটা অজানা চর্মরোগ। এই অসুখেই মা মারা যান।
প্রফেসর বড়ুয়া তাকিয়ে আছেন।
বোরহান সাহেব বললেন, এখনো কি আপনার ধারণা আমার মেয়ের গায়ে যে দাগ সেগুলো ফাংগাসের জন্যে?
অবশ্যই। আপনার স্ত্রীকে আমি দেখি নি কাজেই তাঁর কী হয়েছিল আমি বলতে পারব না। এই মেয়েকে আমি দেখেছি। ওষুধ লিখে দিলাম। আচ্ছা থাক ওষুধ কিনতে হবে না, আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমার কাছে স্যাম্পল আছে। আপনি সাত দিন পর আসবেন। অবশ্যই আসবেন।
আসব।
যে সব প্রেসক্রিপশন আপনার স্ত্রীকে ডাক্তাররা করেছিলেন সেগুলো কি আছে?
থাকার কথা নয়। আমি খুঁজে দেখতে পারি।
অলিক বলল, ডাক্তার সাহেব আমার অসুখটা যদি আপনার কাছে এতই সহজ মনে হয় তাহলে আপনি মার প্রেসক্রিপশন যুঁজছেন কেন?
তোমার চিকিৎসার জন্যে খুঁজছি না। আমি খুঁজছি আমার একাডেমিক ইন্টারেস্টে। তোমার নাম কি খুকী?
অলিক।
সাত দিন পর দেখা হবে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়েই অলিক বলল, মাত্র সাড়ে চারটা বাজে। আমার বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না বাবা। চল কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করা যাক।
কোথায় ঘুরবি?
ঢাকা শহরে কি কোথাও শিমুল গাছ আছে? আমার একটা শিমুল গাছ দেখতে ইচ্ছা করছে।
শিমুল গাছ?
হ্যাঁ। শিমুল গাছ SilkCottonPlant. শিমুল গাছ নিয়ে অপূর্ব একটা কবিতা পড়লাম। শব্দ করে বিচিগুলো ফাটে তারপর বাতাসে ভাসতে ভাসতে তুলা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সত্যি বাবা?
আমি বলতে পারছি না আমার অবস্থাও তোর মতো, শিমুল গাছ দেখা হয় নি। বা দেখলেও কী ভাবে কি হয় জানি না।
কোন সময়টা তুলা বের হয় তা জান?
তাও জানি না। চল বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে খোঁজ নেই।
বাগানের সাজানো গাছ দেখতে ইচ্ছা করছে না বাবা। বাগানের সাজানো গাছ মানে পোষ গাছ। আমি দেখতে চাই বন্য গাছ।
তাহলে খোঁজ খবর করে একটু গ্রামের দিকে যেতে হয়।
বেশ তাই চল।
আজ তো আর হবে না।
আগামীকাল চল। আজ তুমি আমাকে একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যাবে। রাতে ফিরতেও পারি নাও ফিরতে পারি।
তার মানে।
যদি থাকতে ইচ্ছা করে থেকে যাব।
কার বাসা?
বীণাদের বাসা। যদি রাতে থেকে যাই তোমার আপত্তি হবে না তো?
আপত্তি হবে কেন? আমি বরং রাত দশটার দিকে গাড়ি পাঠাব, তোর যদি আসতে ইচ্ছা হয় চলে আসবি। আসতে ইচ্ছা না হলে গাড়ি ফেরত পাঠাবি।
গাড়ি পাঠাতে হবে না বাবা। তোমার ভয় নেই, রাত দশটায় আমি একা একা রওনা হব না।
বোরহান সাহেব মেয়েকে বড় রাস্তায় নামিয়ে দিলেন এবং বললেন, ওষুধটা আজ রাত থেকেই শুরু করিস মা।
করব। আজ রাতে থেকেই শুরু হবে।
বীণাদের বাড়িতে এর আগে একবারই এসেছিল—এত বছর পর ঠিকানা ছাড়া সেই বাড়ি খুঁজে বের করা অসম্ভব ব্যাপার। ঢাকা শহর সাপের মতো বছরে একবার খোলস ছেড়ে নতুন হচ্ছে। অলিক পুরোপুরি ধাঁধায় পড়ে গেল। আগে গ্রামগ্রাম একটা ভাব ছিল, এখন রীতিমতো শহুরে এলাকা। শুধু রাস্তা বেশি বদলায় নি। রাস্তাটা চেনা যাচ্ছে।
অলিক বীণার বাবার নাম জানে না জানলে দোকানে বা লন্ডিতে জিজ্ঞেস করা যেত—অমুক সাহেবের বাসা কোনটা। বীণাদের ভাইদের কারুর নাম জানলে অল্পবয়সী ছেলেদের জিজ্ঞেস করা যেত। এখন সে যা জিজ্ঞেস করতে পারে তা হচ্ছে। বীণাদের বাড়ি কোনটা? সুন্দর মতো একটা মেয়ে লম্বা, ফর্সা এবার বি.এ পাশ করেছে। পাড়ার ছেলেরা নিশ্চয়ই সুন্দরী মেয়েরা কে কোথায় থাকে জানে।
দেখা গেল কেউ জানে না। সম্ভবত এ পাড়ায় অনেকগুলো সুন্দরী মেয়ে থাকে। এবং তাদের সবাই একটি বাড়িতে থাকে যে বাড়ির কর্তা এক জন উকিল। সুন্দমতো একটা মেয়ে বলতেই সবাই বলে—ও আচ্ছা উকিল সাহেবের মেয়েদের কথা বলছেন? উত্তরের তিন তলা বাড়িতে চলে যান।