বীণা বলল, কে?
নরম গলায় জবাব এল—বীণা আমি। আমি বুলু। বাবা বাড়িতে?
বীণা গেট খুলতে খুলতে বলল, এইসব কী কাণ্ড দাদা? কোথায় পালিয়েছিলে?
বাবা কি বাসায়?
না বাবা বাসায় নেই। একি অবস্থা তোমার, ছি ছি।
বুলু লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল, বাসার অবস্থা কি একটু ঠাণ্ডা?
তুমি এখানে দাঁড়িয়ে বক-বক করবে, না ভেতরে আসবে? ইস্ কী অবস্থা হয়েছে।
মৌলানা সাহেব হয়ে গেছি। কি রকম চাপদাড়ি উঠেছে দেখেছিস?
ভেতর থেকে ফরিদা বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিসরে বীণা? কে?
দাদা এসেছে মা।
ফরিদা উঠে বসলেন। কি বলবেন বা কি করবেন বুঝতে পারলেন না। এতদিন পর এসেছে। ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, মা হিসেবে সান্ত্বনার কিছু কথা কি বলা উচিত না? নাকি তিনিও রাগ দেখবেন? মুখ গম্ভীর করে যেভাবে শুয়েছিলেন সেইভাবেই শুয়ে থাকবেন?
বুলু বারান্দায় চলে এল। ফরিদা চমকে উঠলেন। কী চেহারা হয়েছে ছেলের মুখ ভর্তি দাড়ি। আটাশ দিনে এত লম্বা দাড়ি হয় নাকি? চুল মনে হচ্ছে জট পাকিয়ে গিয়েছে। মুখটা শুকনো। ফরিদা বললেন, পায়ে কী হয়েছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেন?
কাঁটা ফুটেছে। মা, বাবার রাগ কমেছে?
রাগ না কমলে কী করবি আবার পালিয়ে যাবি?
বুল লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। হাসি দেখে বড় মায়া লাগল ফরিদার। আহা বেচারা। তিনি নরম গলায় বললেন, মানুষ পরীক্ষায় ফেল করে না? ফেল করলে বাড়ি ঘর ছেড়ে দিতে হয়?
তিনবার তো কেউ ফেল করে না?
ফরিদা বললেন, ছিলি কোথায়?
গ্রামের দিকে ছিলাম।
বীণা ওকে গোছলের পানি দে। সাবান দে।
বীণার দাদী চেঁচাচ্ছেন হারামজাদা আইছে? ওই হারামজাদা, এদিকে আয়।
কুয়ার পাড়ে বুলু গোছল করতে বসেছে। বীণা আছে তার পাশেই। বীণা বলল, পিঠ ভর্তি ময়লা দাদা। দাও, গামছাটা আমার কাছে দাও, ঘষে দেই।
লাগবে না লাগবে না।
আহা দাও না। শরীর এত নোংরা হল কী ভাবে? ইস্ কী ভাবে ময়লা উঠছে। দাদা, মাথায় আরো বেশি করে সাবান দাও তো।
বুলু বলল, তোর রেজাল্ট যে কী প্রথম দুই দিন বুঝতেই পারি নি। নিজেরটা দেখেই অবস্থা কাহিল। থার্ড ডে-তে তোর রেজাল্ট দেখলাম। এত আনন্দ হল বুঝলি—একেবারে চোখে পানি এসে গেল। তোকে মাথায় নিয়ে নাচতে ইচ্ছা করছিল।
একবার এসে তো বললেও না।
বাবার ভয়ে আসি নি।
এখন ভয় করছে না? করছে।
খাওয়া-দাওয়া করে আবার পালাব……
পাগলামি যথেষ্ট করেছ দাদা।
ফরিদা নিজেই ছেলের জন্যে একটা ডিম ভেজে আনলেন। খাবার তেমন কিছু নেই। ছোট মাছের তরকারি ছিল কেমন টক্ টক্ গন্ধ ছাড়ছে। ডালও আছে সামান্য।
মা একটা শুকনো মরিচ ভেজে দাও তো।
ফরিদা একটা শুকনো মরিচ ভেজে আনলেন। বুলু এত আগ্রহ করে খাচ্ছে। এতদিন কোথায় ছিল, কী খেয়েছে কে জানে।
মিজান সাহেব সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ফিরলেন। হাত মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসলেন। ফরিদা বললেন, বুলু এসেছে।
তিনি কিছু বললেন না। ফরিদার মনে হল, কথাটা বোধহয় শুনতে পায় নি। ফরিদা গলা উঁচিয়ে বললেন, বুলু এসেছে।
মিজান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কতবার এক কথা বলবে? এসেছে ভালো কথা। এখন আমাকে করতে হবে কী? কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে?
কিছু বলল না। ভয় পাচ্ছে খুব।
মিজান সাহেব চা শেষ করেই উঠে পড়লেন। ফরিদা বললেন, কোথাও যাচ্ছ নাকি?
তিনি কোনো জবাব দিলেন না। ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আনন্দে লীনা ও বাবলুর চোখে প্রায় পানি এসে যাবার মতো হল। আজ বৃহস্পতিবার, বাবার বইপত্র নিয়ে বসার দিন। একবার যখন বের হয়ে গেছেন তখন বোধ হয় আর বসা হবে না।
বুলু দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেই ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। গা ম্যাজ-ম্যাজ এবং জ্বর-জ্বর ভাব নিয়ে সে শুয়েই রইল। বাঁ পা-টা টাটাচ্ছে।
বীণা চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। এর আগেও সে কয়েকবার এসেছিল। বুলু ঘুমুচ্ছে দেখে ডাকে নি।
বুলু বলল, বাবা আসেন নি?
এসেছিলেন, আবার কোথায় যেন গেলেন।
আমার প্রসঙ্গে কিছু বলেছেন?
না।
চলে যাওয়া দরকার। বাবা আবার ফিরে আসার আগেই বিদায় নেয়া উচিত।
বাজে কথা বলবে না দাদা। যা করেছ যথেষ্ট করেছ। বড়াগুলি খাও। শুধু চা খাচ্ছ কেন?
গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলাম তো বুঝলি বীণা, অনেক কিছু দেখলাম। আমার আগে ধারণা ছিল আমরাই বোধ হয় সবচে গরীব। শুধু ভাত খাচ্ছে বুঝলি। শুধু ভাত। সাথে কিছু নেই।
তুমি কি ওদের নিয়ে কবিতা-টবিতা লিখলে?
বুলু কিছু বলল না। লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। বুলুর মধ্যে কিছুদিন পর পর কবিতা লেখার একটা উৎসাহ দেখা যায়। কোনো কবিতাই সে কাউকে দেখায় না, তবে বীণা ব্যাপারটা জানে।
তুই এম. এ পড়বি না বীণা?
জানি না তো। বাবা কিছু বলছে না।
বলাবলির কি আছে? ভর্তি হয়ে যা। এম.এ পাশ বোন বলতেই ভালো লাগবে। এম. এ জিনিসটাই অন্যরকম, তাই না?
কি জানি।
আমি যদি এম.এ পাশ করতে পারতাম তাহলে গ্রামের দিকে কোনো কলেজে মাস্টারি করতাম। ফাইন হত।
বুলু ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বীণা বলল, সেলুনে গিয়ে দাড়ি-টাড়িগুলো কামিয়ে আস দাদা, বিশ্রী লাগছে। এই নাও।
বীণা পাঁচ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিল। বুলু হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। তার হাত একেবারে খালি। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেটের অভ্যাসটা তার গ্রামে গিয়ে হয়েছে।
বুলু বাসা থেকে হাত খরচের কোনো টাকা পয়সা পায় না। টুক টাক খরচের টাকাটা সে একটা প্রাইভেট টিউশানি করে জোগাড় করে। ওদের কাছ থেকে গত মাসের বেতন নেয়া হয় নি। বুলু ঠিক করল আজ রাতেই একবার যাবে। রাত আটটা নটার আগে না গেলে ছাত্রের বাবাকে পাওয়া যাবে না। টাকাটা পেলে বীণার জন্যে সামান্য কিছু উপহার কিনবে বলে সে ঠিক করে ফেলল। কী কেনা যায়।