মিজান সাহেব চা শেষ করলেন। চা খাবার ফাঁকে ফাঁকে গনি সাহেব দেশ, দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বললেন। মিজান সাহেব উঠে যাবার আগের মুহুর্তে বললেন, আমি আপনার কাগজপত্রগুলি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ভালো করে দেখতে পারি নি। তবু মনে হল দুলাখ পঁচাশি হাজার টাকার একটা সমস্যা আছে। তাই না?
জ্বি স্যার। চিন্তা করে বের করুন তো কী ব্যাপার। টাকাটা বড় না—যেটা বড় সেটা হচ্ছে–।
গনি সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর টেলিফোন এসেছে। তিনি টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এক ফাঁকে মিজান সাহেবকে বললেন, আচ্ছা এখন যান মিজান সাহেব।
মিজান সাহেব সাধারণত নিজের চেয়ারে বসেই লাঞ্চ খান। আজ লাঞ্চের জন্যে ক্যান্টিনে চলে গেলেন। এই অফিসে ক্যান্টিন চালানোর মতো কর্মচারী নেই। ছোট একটা কামরা আলাদা করা আছে। সেখানে চা এবং বিস্কিটের ব্যবস্থা আছে। মিজান সাহেব ক্যান্টিনের এক কোণায় টিফিন বক্স নিয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। গনি সাহেব। খুবই বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছেন এটা যে কোনো বোকা লোকও বুঝতে পারবে। মিজান সাহেব ভেবে পেলেন না এই ব্যাপারটা তার বুঝতে এত দেরি হল কেন?
রহমান সাহেব ক্যাশ সেকশনে আছেন আজ ছবছর। নিতান্তই নির্বিরোধী মানুষ। কারো সঙ্গেই কোনো কথাবার্তা বলেন না। নীরবে কাজ করেন। মাঝেমাঝে দুহাতে মাথার রগ টিপে ধরে ঝিম মেরে বসে থাকেন। এই সময় তাঁর মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়। তীব্র ও অসহ্য ব্যথা। তাঁর ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়। ভুরুর চারপাশে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে। কেউ যদি বলে—কি ব্যাপার রহমান সাহেব। তিনি বলেন–কিছু না। তাঁর ব্যথা কতক্ষণ থাকে কেউ জানে না, কিন্তু তাঁকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কাজ শুরু করতে দেখা যায়। এই সময় তিনি খুব ঘন-ঘন পানি খান কিছুতেই যেন তার তৃষ্ণা মেটে না। তাঁকে বড় অসহায় লাগে।
গনি সাহেব তার সেক্রেটারি মজনু মিয়াকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মজনু মিয়া বিনা কারণে প্ৰচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছে। গনি সাহেব যখনই তাকে ডেকে পাঠান তখনই তার মনে হয় এইবার বোধ হয় তিনি বলবেন, কাজকর্ম তো তোমার কিছুই নেই, কাজেই তোমাকে শুধু শুধু বেতন দিয়ে পোষার মানে নেই। তুমি বিদেয় হও। অথচ মজনু মিয়া কাজ করতে চায়। বিনা কাজে দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত আফসে বসে থাকার যন্ত্রণা আর কেউ না জানুক সে জানে।
মজনু মিয়া।
জ্বি স্যার।
ভালে আছ?
জ্বি স্যার ভালো।
গতকাল কেউ এক জন আমার এখানে এক প্যাকেট সিগারেট ফেলে গেছে। খুঁজে বের করতো। প্যাকেটটা ফেরত দিতে হবে।
মজনু মিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। কে সিগারেট ফেলে গেছে, সে কী ভাবে খুঁজে বের করবে? এটা কি সম্ভব নাকি? তা ছাড়া এক প্যাকেট সিগারেট এমন কী জরুরি জিনিস?
কি পারবে না?
মজনু মিয়া মাথা চুলকাতে লাগল। গনি সাহেব বললেন, বের করা খুব সোজা বলেই তো আমার ধারণা। এই অফিসের কেউ আমার সামনে বসে সিগারেট খায় না—তাই না? বাইরের কেউ হবে। গতকাল আমার কাছে কে-কে এসেছে তোমার জানা আছে না? ওদের মধ্যেই কেউ হবে। খুঁজে বের কর, তারপর গাড়ি নিয়ে প্যাকেটটা দিয়ে আসবে এবং বলবে এখানে একটা সিগারেট কম আছে। আমি খেয়ে ফেলেছি। এই জন্যে আমি খুব শরমিন্দা। বলতে পারবে না?
পারব স্যার।
গাড়ি নিয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
গনি সাহেব পানের কৌটা বের করে একটা পান মুখে দিলেন। বাসায় টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল ঘোট জামাই। তিনি টেলিফোন কানের কাছে ধরে। রাখলেন—এ পাশ থেকে বার-বার শোনা যাচ্ছে, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।
তিনি টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। নামাজের সময় হয়ে গেছে। নামাজ পড়বেন। তিনি ওজুর পানি দিতে বললেন। বাথরুমেই পানির ব্যবস্থা আছে কিন্তু তিনি সে পানি ব্যবহার করেন না। ওজুর জন্যে তিনি পুকুরের পানি ব্যবহার করেন। ড্রামে করে সেই পানি জমা রাখা হয়।
চারদিক কেমন নিঝুম
দুপুর বেলা চারদিক কেমন নিঝুম হয়ে থাকে।
ফরিদা বারান্দায় পাটি পেতে শুয়ে থাকেন। বাবলু, লীনা স্কুলে। বীণা সারা দুপুর কুয়াতলায় বসে কি সব বইপত্র পড়ে। সুনসান নীরবতার মধ্যে একমাত্র সরব ব্যক্তি বীণার দাদী। যদিও দুপুর বেলায় তার গলা খাদে নেমে যায়। একঘেয়ে স্বরে তিনি বিড়বিড় করেন। সেই বিড়বিড়ানির মধ্যে ঘুম পাড়ানো কোনো সুর হয়ত আছে। শুনতে শুনতে ফরিদার ঘুম পেয়ে যায়।
আজও ঘুম পেয়ে গেল।
ঘুম ভাঙল খট্ খট্ শব্দে। গেট দুপুরে ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। ভিখিরীর দল। খানিকক্ষণ খটু খটু করে এক সময় বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আজ যে এসেছে সে কিছুতেই যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আবার শব্দ করে, ফরিদা বিরক্ত গলায় বললেন, বীণা একটু দেখ তো। এরা বড় যন্ত্রণা করে।
বীণা চিঠি লিখছিল। তার চিঠি লেখার কোনো মানুষ নেই। অথচ কর্মহীন পরে কেন জানি শুধু চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে। অবিশ্যি আজকের চিঠিটি সে লিখছে মালবীকে। মালবীর সঙ্গে তার তেমন কোনো ভাব নেই। তবু মালবী তার একমাত্র বান্ধবী যে হঠাৎ করে তাকে দীর্ঘ চিঠি লিখে বসে। গতকাল মালবীর একটা চিঠি এসেছে। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে—এই খবর জানিয়ে দীর্ঘ চিঠি। ছেলে বাংলাদেশের চায়না এ্যাম্বেসির কালচারাল সেক্রেটারি। হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হয়েছে। দেশ ছেড়ে মালবীকে চলে যেতে হবে এই দুঃখেই সে কাতর। চিঠির জবাব লিখতে গিয়ে বীণার নিজের কেন জানি একটু মন খারাপ লাগছে। সে খাতা বন্ধ করে গেট খুলতে গেল। ভর দুপুরে আজকাল গেট খোলাও বিপজ্জনক। হুট করে কে না কে ঢুকে পড়ে।