বুলুকে তিনি কি বলবেন? আদরের ভঙ্গিতে বলবেন, চল বাসায় চল। নাকি ঠাণ্ডা গলায় বলবেন, বাসায় যা। তিনি নিজেও কি বুলুর সঙ্গে বাড়ি ফিরবেন, না বুলুকে ফেরার কথা বলে সহজ ভঙ্গিতে অফিসের দিকে রওনা হবেন। যেন এক মাস পর ছেলের দেখা পাওয়া তেমন কোনো ঘটনা না। কিংবা তেমন কোনো ঘটনা হলেও একে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
বুলু সিগারেট ফেলে উঠে দাঁড়াতেই মিজান সাহেব চমকে উঠলেন—এ বুলু নয়। চোয়াডে ধরনের একটা ছেলে। চেহারায় বুলর সঙ্গে কোনো মিল নেই অথচ তিনি এতক্ষণ ধরে তাকে বুলু ভাবছেন—এর কারণ কি? গায়ের শার্টটাই কি কারণ? বুলুরও এই রকম একটা শার্ট আছে। খয়েরি রঙের শার্ট।
মিজান সাহেব বাসে উঠে পড়লেন। তাঁর মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। খয়েরি রঙের চেক শার্ট পরা ছেলে এই শহরে নিশ্চয়ই অনেক আছে। তাদের সবাইকে কি তিনি এখন থেকে বুলু বলে ভুল করবেন? তিনি জানালার পাশে একটা সিট পেয়েছেন। বাসে জানালার পাশে বসলে আপনাতেই মনটা ভালো হয়। আজ হচ্ছে না।
অফিসে ঢুকবার মুখে বেয়ারা অজিত বলল, স্যার আফনের ছেলে ফিরছে?
মিজান সাহেব জবাব দিলেন না। এই এক যন্ত্রণা হয়েছে। অফিসে আসামাত্র সবাই একবার জিজ্ঞেস করবেছেলে ফিরেছে কিনা। বুলু ফিরেছে কি ফেরে নি এই নিয়ে কারো কোন আগ্রহ নেই। অথচ সবাই জিজ্ঞেস করে। এটা যেন একটা রুটিন কাজ। আপনি ভালো আছেন? এর মত একটা বাক্য। প্রশ্নকর্তা অভ্যাসের মতো জিজ্ঞেস করেন। ভালো থাকলেও প্ৰশ্নকর্তার কিছু যায় আসে না, ভালো না থাকলেও না।
নিজের ঘরে ঢোকার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পাশের কামরার করিম সাহেব চায়ের কাপ হাতে চলে এলেন চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, কোনো খবর পাওয়া গেল?
বেয়ারা শ্রেণীর কারোর প্রশ্নের জবাব না দিলে চলে কিন্তু সহকর্মীদের প্রশ্নের জবাব। দিতে হয়। মিজান সাহেব বললেন, না।
বলেন কি? এক মাসের মতো হয়ে গেল না?
জ্বি।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এদের কাছে খোঁজ করেছেন?
না।
করা দরকার, তারপর থানায় একটা জিডি করিয়ে রাখুন। সময় খারাপ, কিছুই বলা যায় না।
মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন। ছেলের প্রসঙ্গে কথা বলতে তাঁর ভালো লাগছে না কিন্তু উপায় নেই। অপ্রিয় বিষয় নিয়েই মানুষকে বেশি কথা বলতে হয়।
মিজান সাহেব।
জ্বি।
চিন্তা করবেন না। চিন্তার কিছু নেই। এই বয়েসে ছেলেদের ঘর পালানো রোগ হয়। আমার নিজের ভাগ্নে এই কাজ করল। ফুফাত বোনের ছেলে। রাগ করে বাড়ি থেকে উধাও। দুমাস ওর কোনো খোঁজ ছিল না পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, রেডিওতে বিজ্ঞাপন বিরাট হুলুস্থুল। আর কত রকম গুজব। একবার তো খবর পাওয়া গেল লঞ্চড়ুবিতে মারা গেছে। বুঝেন অবস্থা, আমার বোন ঘন-ঘন ফিট হচ্ছে…..
মিজান সাহেব ফাইলে মন দিতে চেষ্টা করলেন। মন বসছে না। ভালো লাগছে না। কিছুই ভালো লাগছে না। মাথায় একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।
মিজান সাহেব।
জ্বি।
থানায় একটা জিডি করিয়ে রাখা দরকার। তাছাড়া এটা একটা নাগরিক কর্তব্য। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাগে আছে মোহাম্মদপুর থানার ওসি। বলেন তো আমি নিয়ে যাব।
মিজান সাহেব কিছু বললেন না। করিম সাহেব বললেন, আজ বিকেলে অফিস ছুটির পর যাওয়া যেতে পারে, যাবেন?
না।
কথাবার্তা হয়ত আরো কিছুক্ষণ চলত। গনি সাহেব ডেকে পাঠালেন।
গনি সাহেবকে আজ অন্যদিনের চেয়েও গম্ভীর মনে হচ্ছে। গম্ভীর এবং চিন্তিত। তিনি সিগারেট খান না কিন্তু আজ হাতে সিগারেট। অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে টান দিয়ে খুক খুক করে কাশছেন। মিজান সাহেব বললেন, স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। ভালো আছেন?
জ্বি ভালো।
বসুন, মিজান সাহেব বসুন।
মিজান সাহেব বসলেন। গনি সাহেব বললেন, কিছু ভেবেছন?
মিজান সাহেব তাকিয়ে রইলেন। গনি সাহেব বললেন, আপনাকে বললাম না, জনহিতকর কিছু করতে চাই। টাকা কোনো সমস্যা হবে না। ঐটা মাথায় রেখে ভাববেন। বুঝতে পারছেন?
পারছি।
চা খান।
গনি সাহেব বেল টিপে চায়ের কথা বললেন। তাঁর সিগারেট নিভে গিয়েছিল, সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, সিগারেট আমি খাই না। কে যেন একটা প্যাকেট ফেলে গিয়েছিল। একটা ধরালাম। এখন মাথা ঘুরছে। আচ্ছা ভালো কথা— গণ্ডগোলটা ধরেছেন? মানে আপনার ঐ হিসাবে?
মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন। গনি সাহেব বললেন, আমাদের হিসাব পত্রের ব্যাপারগুলি আরো আধুনিক করা দরকার। আমি ভাবছি হিসাব নিকাশের সুবিধার জন্যে একটা কম্পুটার রাখলে কেমন হয়? আপনি কি বলেন?
আমি তো স্যার ঐসব ঠিক জানি না।
আমি নিজেও জানি না। দিনকাল বদলাচ্ছে। আমাদেরও তো সেইভাবে বদলাতে হবে। কি বলেন, ঠিক বলছি না?
ঠিকই বলছেন।
আমি দুতিন জন কম্পুটারওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা কি বলে জানেন? ওরা বলে হিসাবটা কম্পুটারে থাকলে আজ যে সমস্যা আপনার হয়েছে সেই সমস্যা হত না।
জ্বি স্যার।
আমাদের অফিসের রহমান সাহেবের ছেলের কিডনির কী অসুখ যেন ছিল, কি হয়েছে জানেন?
এখন ভালো আছে।
আলহামদুলিল্লাহ। কিডনি ট্রান্সপ্লেন্ট হয়েছিল তাই না?
জ্বি। তাঁর স্ত্রী কিডনি দিলেন।
ভালো। ভালো। খুবই ভালো। ভাবছিলাম একবার দেখতে যাব। খোঁজ নেবেন তো বাসাটা কোথায়?
শান্তিনগরে বাসা।
ঠিক আছে। একবার যাব। অপারেশনটা হল কোথায়?
মাদ্রাজে।
বিরাট খরচান্ত ব্যাপার তো।
লাখ তিনেক টাকা খরচ হয়েছে স্যার।
তা তো হবেই। বিদেশে চিকিৎসা। লাখ তিনেক হলে তো কমই হয়েছে। নিন চা খান। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।