অলিক বলল, হ্যাঁ।
অনেক গল্প-টল্প করল?
হ্যাঁ। খুব বক-বক করতে পারে। সারা পৃথিবী ঘুরছে। আন্টার্কটিকায়ও নাকি গিয়েছিল।
বলিস কি?
হ্যাঁ সত্যি। ছবি দেখাল। পেঙ্গুইন কোলে নিয়ে ছবিতার ধারণা পৃথিবীর সবচে সুন্দর দেশ হচ্ছে আন্টার্কটিকা।
সুন্দরের কী আছে? সব তো বরফে ঢাকা।
এই জন্যেই নাকি সুন্দর। ওখানে গেলেই নাকি পবিত্র ভাব হয়। আমি ঠিক করেছি একবার আন্টার্কটিকা যাব।
বেশ তো যাবি।
আন্টার্কটিকা যেতে কি ভিসা লাগে বাবা?
লাগার তো কথা না। আমি যতদূর জানি ঐটি একমাত্র মহাদেশ যেখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষদের অধিকার আছে।
বাহ খুব একসাইটিং তো।
বোরহান সাহেব হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, তুই একা যাবি, নাকি ঐ ইংরেজকে নিয়ে যাবি?
ওকে সঙ্গে নেব কেন? ও এক জন বাজে ধরনের লোক।
একটু আগে তো অন্যরকম বললি।
মোটও অন্যরকম বলি নি। ঐ লোকটা ফস করে আমার হাত ধরল।
ওদের মধ্যে মেয়েদের হাত ধরা তেমন দোষণীয় কিছু না।
তা জানি বাবা। কিন্তু শিপ্রা যখন আমাদের ছবি তুলতে গেল তখন সে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়াতে গেল। আমি দিলাম এক ধমক।
বোরহান সাহেব চুপ করে গেলেন। অলিক বলল, চমৎকার ইংরেজিতে আমি তাকে বললাম—কোনো সাদা চামড়ার লোক আমাকে জড়িয়ে ধরে, এটা আমার পছন্দ নয়। আমার গা ঘিন ঘিন করে। তুমি কালো হলে একটা কথা হত।
সত্যি বললি?
হ্যাঁ বললাম। ব্যাটার মুখটা দেখতে দেখতে ছোট হয়ে গেল। সবচে রাগ করল শি। সে বলল, এইভাবে এক জনকে অপমান করার নাকি আমার কোনো রাইট নেই। বাবা আমার কি রাইট আছে?
অবশ্যই আছে।
বোরহান সাহেব রাত একটা পর্যন্ত মেয়ের সঙ্গে গল্প করলেন। যে কথাগুলো বলতে এসেছিলেন সেগুলো বলতে পারলেন না। কথাগুলো তেমন জরুরি নয়। It can wait.
বাবা চলে যাবার পরও অলিক জেগে রইল। প্রতি সপ্তাহে একটি করে কবিতা মুখস্থ করার কথা। দুসপ্তাহ বাদ গেছে। মুখস্থ করার মতো তেমন কোনো কবিতা পাওয়া যাচ্ছে না। কোনোটাই ভালো লাগছে না।
ঘুমুতে যাবার ঠিক আগে আগে অলিক আয়নার সামনে দাঁড়াল। তার গায়ে নীল রঙের সুতির নাইটি। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাইটির ফিতা খুলে নিজের অনাবৃত দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। বাঁ দিকের পাঁজরের নিচে এবং নাভীর ডান পাশের চামড়া কেমন বিবর্ণ হয়ে ফুলে আছে। মার অসুখের প্রথম অবস্থায় ঠিক এই রকম হয়েছিল।
অলিকের শরীরটা বড় সুন্দর। অলিক নিজেই মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখেছে। এখনো দেখছে। তার দৃষ্টি বার বার ফিরে যাচ্ছে দাগ দুটির দিকে।
এই দাগ দুটিকে সে কী বলবে? চাঁদের কলঙ্ক? না-কলঙ্ক না। চাঁদের কলঙ্ক স্থির থাকে, এরা স্থির থাকবে না। বাড়তে থাকবে। বাড়তে বাড়তে থাক ঐ নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না। সুন্দর কিছু নিয়ে ভাবা যাক। শ্বেত শুভ্র আন্টার্কটিকা, নির্মল পবিত্র। কিংবা টেড হিউজের থট ফক্স। Till with a sudden sharp hot stink of Fox.
বাংলা অনুবাদ করা যায় না? কেন যাবে না? চেষ্টা করলেই হবে–
জানালার ও পাশে ছিল নিস্তব্ধ আকাশ।
চারদিকে আদিগন্ত ধূসর প্রান্তর।
সময় দাঁড়িয়ে ছিল এক পায়ে, ফেলছিল ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস।
মস্তিষ্কের লক্ষ নিওরোনে—গাঢ় অন্ধকার।
হঠাৎ উড়ে এল বোধ।
অলৌকিক স্বপ্নময় বোধ।
কবির লেখার খাতায়–গান, সুর ও স্বর।
ব্যাপারটা কেমন হল? শেয়াল বাদ পড়ে গেল না? কোথাও একটা লাইন ঢোকানো দরকার ছিল, যেখানে ঝাঁঝাল গন্ধের নিশাচর শেয়াল গর্তে ঢুকবে।
অলিক বিছানায় শুয়ে বাতি নেভানো মাত্ৰ বৃষ্টি শুরু হল। চমৎকার কাকতালীয় ব্যাপার। বৃষ্টিটা পাঁচ মিনিট আগে বা পরেও শুরু হতে পারত। তা হল না। বাতি নেভানো এবং বৃষ্টির শুরুটা হল একই সঙ্গে।
এ রকম কাকতালীয় ব্যাপার মানুষের জীবনে নিশ্চয়ই খুব বেশি আসে না।
কিংবা কে জানে হয়ত খুব বেশিই আসে, কেউ কখনো লক্ষ করে না। মানুষ কখনো কিছু লক্ষ করে না। তার চোখের সামনে কত কিছু ঘটে সে তাকিয়ে থাকে কিন্তু দেখে না। মানুষের দেখতে না পারার ক্ষমতা অসাধারণ।
অলিকের এখন একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে। তবে চিঠিটা লেখা হবে। অন্ধকারে। মুশকিল হচ্ছে অন্ধকারে চিঠি লেখার কোনো উপায় নেই। থাকলে ভালো হত।
চিঠি কাকে লেখা যায়? কবি কিটসকে লিখলে কেমন হয়? মৃত মানুষদের কাছে চিঠিপত্র লেখার আলাদা আনন্দ আছে। চিঠির উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না।
মাথা নিচু করে চা খাচ্ছে
এটা কে?
বুলু না?
মাথা নিচু করে চা খাচ্ছে। গায়ে চেক হাওয়াই শার্ট। হাতে একটা সিগারেটও আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। পেছনটা দেখা যাচ্ছে। মিজান সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। কল্যাণপুর বাস ডিপোর সঙ্গের রেস্টুরেন্ট। বখা ছেলেদের আড্ডা। এদের মধ্যে এক জন আছে—অতি বদ। স্কুল ড্রেস পরা কোনো মেয়ে দেখলেই কিছু না কিছু বলবে। কদর্য কিছু কথা যার সঙ্গে রসিকতা মেশানো। কথা শেষ হওয়া মাত্র রেস্টুরেন্টের সবাই একসঙ্গে হেসে উঠবে।
বুলু এই দলের মধ্যে বসে আছে? ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। বুল তেমন ছেলে না। তবে কোনো বাবা-মা নিজের ছেলেমেয়েদের খুব বেশি চেনেন না। মিজান সাহেবও হয়ত চেনেন না। একটা বিশেষ বয়স পর্যন্ত তাদের চেনা যায়, তারপর আর যায় না।
মিজান সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। বুলুর হাতের সিগারেটটা শেষ হোক। বুলু সিগারেট ধরেছে এটা অবশ্যি খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু মিজান সাহেব কেন জানি তেমন দুঃখিত বোধ করলেন না। এর কারণ কি কে জানে। হয়ত তাঁর মনে ভয় ছিল বুলুকে পাওয়া যাবে না। অবশ্যি এমন কিছু সচেতন ভাবে তিনি ভাবেন নি, তবে অবচেতন মন বলে একটা ব্যাপার আছে। যেই মন গোপনে অনেক কিছুই ভাবে।