অলিকের বাবা বোরহান সাহেব ইদানীং মাথায় কলপ দিচ্ছেন। মাথার চুল হঠাৎ সব চকচকে কালো হয়ে যাওয়ায় তাঁর বয়স অনেকখানি কম মনে হয়। কম বয়েসী একটা ভাব তাঁর চলা ফেরায়ও চলে এসেছে। এখন তাঁর গায়ে নীল রঙের একটা হাওয়াই শার্ট। তিনি হাসিমুখে বললেন, মাই ডিয়ার মাদার, তুমি কেমন আছ?
ভালো আছি। তুমি যুবক সেজে কোথায় যাচ্ছ বাবা?
বোরহান সাহেব লজ্জা পেয়ে গেলেন। অপ্ৰস্তুত গলায় বললেন, শার্টটা কি বেশি। ছেলেমানুষী হয়ে গেল?
কিছুটা হয়েছে।
আগলি দেখাচ্ছে?
হুঁ।
বলিস কী—আমার কাছে তো মনে হচ্ছে সোবার কালার। আটচল্লিশ বছর বয়সে এই কালার পরা যায়।
আটচল্লিশ না বাবা পঞ্চাশ।
ও সরি। ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে আটচল্লিশ। কাগজপত্রের বয়সটাকেই কেন জানি সব সময় সত্যি বয়স মনে হয়।
অলিক বাবার দিকে তীক্ষ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা গলায় বলল, বয়স কমানোর দিকে তুমি হঠাৎ এমন মন দিলে কেন? তোমার কি অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে?
বোরহান সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের তুখোড় সচিবদের একজন। যে কোনো জটিল পরিস্থিতি তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সামলে নিতে পারেন। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত কিছু-কিছু গল্প সচিবালয়ে প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। সেই গল্পের একটি হচ্ছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়কার।
সচিবদের বৈঠক বসেছে। প্রেসিডেন্ট এসে ঢুকলেন এবং চুরুট হাতে বোরহান সাহেবকে দেখে শীতল গলায় বললেন, চুরুট ফেলে দিন।
বোরহান সাহেব সহজ ভঙ্গিতে বললেন, কেন স্যার?
চুরুটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না।
একসঙ্গে কাজ করতে হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয় স্যার। আপনি যেমন আমাদের অনেক কিছু সহ্য করতে পারেন না আমরাও আপনার অনেক কিছু সহ্য করতে পারি না। তবু চুপ করে থাকি।
আমার কোন্ জিনিসটি আপনারা সহ্য করতে পারেন না?
ঘরের ভেতরে মিটিং চলার সময়ও আপনি সানগ্লাস পরে থাকেন এইটি।
জিয়াউর রহমান সাহেব সানগ্লাস খুলে টেবিলে রাখলেন। বোরহান সাহেব তার চুরুট ফেলে দিলেন। মিটিং শুরু হল।
বোরহান সাহেব মানুষটা স্মার্ট। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত স্মার্ট। তবু নিজের মেয়ের কাছে মাঝে-মাঝেই তিনি অসহায় বোধ করেন। এই মুহূর্তে করছেন। অলিক জানতে চাচ্ছে-তোমার কি অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে?
তাঁর উচিত খুব সহজভাবে এর উত্তর দেয়া। কিন্তু তিনি দিতে পারছেন না। প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না—অলিকের সঙ্গে লুকোচুরি চলবে না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন তাঁর এই পাগলা ধরনের মেয়েটি তাঁর মতোই স্মার্ট।
বোরহান সাহেব প্রাণহীন গলায় বললেন, পরে তোমার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলব।
ঠিক আছে।
আজ রাতেই কথা বলা যাবে।
ওকে।
ফাদার এন্ড ডটার, ক্লোজ ডোর টক।
তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন বাবা? তুমি কী বলবে আমি জানি। তুমি চাইলে এখনো কথা বলতে পার। আমার হাতে সময় আছে। আমার ক্লাস এগারটায়। মনে হচ্ছে এই ক্লাসটা করব না।
ক্লাস না করে কী করবে? ঘরে বসে থাকবে?
হ্যাঁ।
সারাদিন ঘরে বসে কী কর?
কিছু করি না।
তোমার কি বন্ধু-বান্ধব নেই?
এক জন আছে।
মাঝে-মাঝে ওর সঙ্গে গল্প-টল্প করতে পার না?
আমি ওর ঠিকানা জানি না বাবা।
সে কী।
জানি না বলাটা ঠিক হচ্ছে না। এক সময় জানতাম। ওদের বাসায়ও একদিন গিয়েছিলাম। ওর দাদী আমাকে বলল, মর হারামজাদী।
কি সব পাগলের মতো কথা বার্তা।
ঠিক বলেছ বাবা। মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
বোরহান সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মেয়ের প্রতি যথেষ্ট সময় দেয়া হচ্ছে না, আরো সময় দেয়া দরকার। প্রচুর সময়। মেয়েকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়? ছুটি কি পাওয়া যাবে?
টেলিফোনের শব্দে অলিকের ঘুম ভাঙল। টেলিফোন করেছেন বড় মামীর মেয়ে শি। শিকে অলিক পছন্দ করে না আবার করেও। অর্থাৎ শিপ্রার কিছু কিছু ব্যাপার তার ভালো লাগে তার মধ্যে একটা হচ্ছে নতুন কিছু করা। এমন কিছু যা আগে কোনো মেয়ে করে নি। মুশকিল হচ্ছে এ রকম নতুন কিছু সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। শালবনে রাত জেগে জ্যোৎস্না দেখা বা নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে ছেলে সেজে ঢাকা থেকে গাড়ি করে টঙ্গি যাওয়া তেমন নতুন কিছু না।
হ্যালো অলিক কেমন আছিস?
ভালো।
ঘুমুৰ্চ্চিস নাকি?
হ্যাঁ ঘুমাচ্ছি। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কথা বলছি।
ভ্যাট ফাজিল—একটা একসাইটিং ব্যাপার হয়েছে। এক জন ভবঘুরের সঙ্গে পরিচয় হল।
কার সঙ্গে পরিচয়।
ভবঘুরে। তোদের ইংরেজি সাহিত্যে যাকে বলা হয় ভ্যাগাব। চলে আয়, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। এখন বাসায় বসে আছে। এই মুহূর্তে দাড়ি চুলকাচ্ছে। ব্যাটার আবার রবীন্দ্রনাথের মতো লম্বা দাড়ি।
ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গে পরিচয় করবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করছি না শিপ্রা।
তুই যা ভাবছিস তা না কিন্তু। ইংরেজ ভ্যাগাবন্ড।
ভ্যাগাবন্ড হচ্ছে ভ্যাগাবন্ড, সে ইংরেজই হোক আর বাঙালিই হোক।
অলিক, তুই বুঝতে পারছি না, এই ব্যাটা দস্তয়েভস্কির উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্র।
দস্তয়েভস্কির কোনো উপন্যাস তো তুই পড়িস নিজানলি কী করে উপন্যাসের চরিত্রগুলি কেমন?
তোর সঙ্গে বক-বক করতে ভালো লাগছে না। আমি ব্যাটাকে নিয়ে আসছি। ব্যাটার চোখের দিকে তাকালে তুই পাগল হয়ে যাবি–sky blue. রওনা হচ্ছি কিন্তু।
অনেক রাতে বোরহান সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকে হাসি মুখে বললেন—কোন এক বিদেশি নাকি এসেছিল?