মার শুরু হয়েছে।
রাগে অন্ধ হয়ে মার।
বাবলু গোঙাতে গোঙাতে বলল, তুমি আমার একটা কথা শোন বাবা। তুমি আমার একটা কথা শুধু শোন।
কী কথা?
আমি আর বই হারাব না।
কথা শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ।
মার আবার শুরু হল। বাবলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কোনোদিন বই হারাব না বাবা। কোনোদিন বই হারাব না।
চুপ।
বাবা, আমার একটা কথা শুধু শোন। একটা মাত্ৰ কথা।
চুপ।
কিছুক্ষণ মারের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। তারপর শোনা গেল বাবলুক্ষীণ স্বরে ডাকছে—আপা, ও আপা, ও বড় আপা।
বীণা বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের ঘর থেকে বীণার দাদী চিৎকার করছেন, বিষয় কি? বিষয় কি? ও হারামজাদার দল বিষয় কি?
কেউ তাঁর কোনো জবাব দিচ্ছে না।
বাবলু রাতে কিছুই খেতে পারল না। তার সমস্ত গা ফুলে উঠেছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। বীণা এক গ্লাস গরম দুধ এনে দিয়েছিল, খানিকটা খেয়েই বমি করে ফেলল। রাত দশটার দিকে মিজান সাহেব এক জন ডাক্তার ডেকে আনলেন। হতভম্ব ডাক্তার বললেন, এরকম হল কীভাবে?
মিজান সাহেব বললেন, আমি মেরেছি। হাড় গোড় ভেঙেছে কিনা এইটা আপনি দেখুন।
ডাক্তার স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাবলুকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, ব্যথা লাগছে খোকা?
বাবলু বলল, জ্বি না।
ডাক্তার সাহেব বললেন, এত মেরেছেন কেন? ছেলে কী করেছে?
মিজান সাহেব শীতল গলায় বললেন, কী জন্যে মেরেছি তা দিয়ে তো আপনার দরকার নেই ভাই। চিকিৎসা করতে এসেছেন চিকিৎসা করে চলে যাবেন।
মিজান সাহেব ভিজিটের টাকা বের করলেন।
বীণা রাতে কিছু খায় নি। কয়ার পাশে একা একা বসে আছে। ফরিদাও খান নি। তিনি দুজনের জন্যে ভাত বেড়ে কুয়ার পাড়ে মেয়েকে ডাকতে এলেন।
ভাত খাবি আয়রে বীণা।
ভাত খাব না মা। কেন খাবি না?
ইচ্ছে করছে না। তাই খাব না।
তোর বাবার উপর রাগ করেছিস?
না। বাবার উপর আমি রাগ করি নি মা। রাগ করেছি তোমার ওপর। কেন তুমি বাবাকে আটকাও না? কেন এই সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক?
ফরিদা ক্ষীণ স্বরে কী বললেন কিছু বোঝা গেল না। বীণা বলল, আমাকে সাধাসাধি করে কিছু হবে না মা। আমি ভাত খাব না। তুমি বরং বাবলুর কাছে যাও। বাবলুকে একটু আদর টাদর কর।
বাবলু ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুমিয়ে পড়লে তো ভালোই। তুমিও খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
তুই এখানে বসে থাকবি নাকি?
না আমিও ঘুমুব। এখানে শুধু শুধু বসে থাকব কেন?
ফরিদা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
বাবলু ঘুমায় নি। সে এবং লীনা এক খাটে ঘুমায়। অন্য খাটে বুলু। বুলু নেই বলে দুজন দুখাটে ঘুমুচ্ছে। আজ লীনা শুয়েছে বাবলুর সঙ্গে। তারা দুই ভাইৰােন প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে। নিছ গলায় গল্প। সেই সব গল্পের কোনো আগা নেই। মাথা নেই। আজও দুজন গল্প করছে। বেশিরভাগ কথা লীনাই বলছে। বাবলু হা হু দিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে লীনা হঠাৎ বলল, বেশি ব্যথা পেয়েছিলি বাবলু?
বাবলু বলল, হ্যাঁ। লীনার সঙ্গে নিশিরাতের কথা বার্তায় সে কখনো মিথ্যা বলে না।
বীণা অনেক রাতে ঘুমুতে গেল।
দাদী তখনো জেগে। বীণার পায়ের শব্দ শুনেই বললেন, তোর বাবার মাথায় কী হইছে রে বীণা? আইজ আবার মারল? এরা হইল পাগলের বংশ বুঝলি। আমার শশুরের বাপ ছিল পাগল। বদ্ধ পাগল। হেই বংশের ধারা। রক্ত বড় কঠিন জিনিস। মানুষ মইরা যায় রক্ত থাকে। বাপের কাছ থাইক্যা পায় পুলা। পুলার কাছ থাইকা তার পুলা। তার পুলার কাছ থাইকা তার পুলা। তার পুলার কাছ থাইক্যা…..
চুপ কর দাদী।
তুই চুপ কর হারামজাদী। তুই মর।
বীণা কথা বাড়ায় না। শুয়ে পড়ে। অসহ্য গরমে তার ঘুম আসে না। জেগে জেগে শুনে বারান্দায় বাবা হাঁটাহাঁটি করছেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যাচ্ছেন। আবার ফিরে আসছে। বীণা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
গরম লাগছে। গা ঘেমে যাচ্ছে। ই একটা ফ্যান যদি এ ঘরে থাকত।
অলিকের ক্লাস ছিল এগারটায়
অলিকের ক্লাস ছিল এগারটায়-পোয়েট্রি ক্লাস। আজ পড়ানো হবে টেড হিউজের থট ফক্স। রাতের বেলা সে একবার পড়ল। পড়ে মনে হল—বাহ বেশ তো। সুন্দর কবিতা।
Till with a sudden hot stink of fox
It enters the dark hole of the head.
The window is starless still: the clock ticks,
The page is printed.
এর বাংলা কী হবে? কবির মাথায় হঠাৎ কবিতার একটা বোধ ঢুকে পড়ল। কি অদ্ভুত ভাবেই না বোধটা এল। যেন—বোধ হচ্ছে নিশাচর এক শেয়াল। যে শেয়াল তার গায়ের তীব্র গন্ধ নিয়ে অন্ধকার গর্তে ঢুকে পড়ে।
কবিতার বোধ জাতীয় ব্যাপারগুলো সাধারণত স্বগীয় বলে মনে করা হয়, কিন্তু এই কবি কী অদ্ভুত উপমাই না দিলেন। শেয়ালের গায়ের তীক্ষ্ণ গন্ধের কথা বললেন। আসলেই কি শেয়ালের গায়ে কোনো গন্ধ আছে, না, এটাও কবির কল্পনা?
ময়নার মা চা নিয়ে এসেছে। সে ভয়ে ভয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। ক্ষীণ স্বরে বলল, আইজ ইউনিভার্সিটিতে যাইবেন আফা?
হ্যাঁ যাব। আচ্ছা ময়নার মা, তুমি শেয়াল দেখেছ?
ময়নার মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
শেয়াল দেখ নি?
দেখছি আফা।
শেয়ালের গায়ে কি গন্ধ আছে?
ক্যামনে কই আফা।
ঠিক আছে তুমি যাও।
অলিকের মন খারাপ হয়ে গেল। তার একুশ বছর বয়স। অথচ সে শেয়াল দেখে। নি। চিড়িয়াখানায় কি শেয়াল আছে? থাকলে একবার দেখে আসা যেত। চিড়িয়াখানায় টেলিফোন করে দেখবে নাকি? অলিক চায়ের পেয়ালা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা। হতেই বোরহান সাহেবের মুখোমুখি হয়ে গেল।