- বইয়ের নামঃ অন্ধকারের গান
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
বুলুদের এই বাড়ির মতো বাড়ি
বুলুদের এই বাড়ির মতো বাড়ি বোধহয় ঢাকা শহরে খুব বেশি নেই।
পুরানো আমলের হিন্দু বাড়ি। তুলসি মঞ্চ আছে। ছোট্ট একটা ঠাকুর ঘর আছে। ঠাকুর ঘরের দক্ষিণে গহীন একটা কুয়া। বাড়ির গেটে সিংহের দুটি মূর্তি।
প্রায় ত্রিশ বছর আগে, ১৯৫৮ সনে বাড়ির মালিক নিত্যরঞ্জন বাবুর কাছ থেকে। বুলুর বাবা মিজান সাহেব এই বাড়ি জলের দামে কিনে নিয়েছিলেন। এত সস্তায় বাড়ি পেয়ে মিজান সাহেবের আনন্দের সীমা ছিল না। পরে দেখা গেল নিত্যরঞ্জন বাবু এই বাড়ি দুজনের কাছে বিক্রি করেছেন এবং তৃতীয় এক জনের কাছ থেকে বায়নার টাকা নিয়েছেন। নিত্যরঞ্জন বাবুর মতো ভালোমানুষ ধরনের বোকা সোকা একটা লোক যে এই কাণ্ড করতে পারে তা মিজান সাহেব স্বপ্নেও ভাবেন নি।
মিজান সাহেবকে বাড়ির দখল নেয়ার জন্যে নানান কাণ্ড করতে হল। টাকা-পয়সা দিতে হল, কোর্ট কাছারি করতে হল। নিত্যরঞ্জন বাবুর খোঁজে একবার কোলকাতায়ও গেলেন। দেখা গেল ঠিকানাটাও ভুয়া। অনেক হাঙ্গামা করে বাড়ির দখল মিজান সাহেব পেলেন কিন্তু তাঁর কোমর ভেঙে গেল। শুরুতে তাঁর কাছে এ বাড়ি যত সুন্দর লেগেছিল বাড়িতে উঠার পর তা লাগল না। বার-বার মনে হল এই বাড়িটা ভালো না, অশুভ কিছু এখানে আছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখানে আসা উচিত হয় নি।
গেটের সিংহ দুটিকে কোনো-কোনো রাতে জীবন্ত মনে হয়। বাড়ির পেছনের কুয়া থেকে মাঝেমাঝে গভীর রাতে তিনি পানি ছিটানোর কল কল শব্দ পান। এ রকম শব্দ হবার কথা নয়। হয় কেন? তিনি গেটের সিংহ দুটি ভেঙে ফেললেন। কুয়ার কিছু করতে পারলেন না।
বুলুদের অবশ্যি এই কুয়া খুব পছন্দ। তারা যখন ছোট তখন কুয়ার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলত—টু টু টু। কুয়া সেই শব্দ অনেকগুণে বাড়িয়ে ফেরত পাঠাত। পরে সেই টু-টু খেলার অনেক রকমফের হল। দেখা গেল কুয়া শব্দ উল্টো করে ফেরত পাঠাতে পারে। বুল বলে কেঁচালে কিছুক্ষণ পরে শোনা যায়, লুবু-লুবু-লুবু। খুবই মজার ব্যাপার। এক দুপুরে বুলু কুয়ার পাড়ে বসে খুব চেঁচালচাপ, চাপ, চাপ। সেই শব্দ উল্টো হয়ে ফেরত এল—পচা, পচা, পচা। বুলুর মহা আনন্দ।
এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। মিজান সাহেব কুয়ার ওপর ভারি পাটাতনের ব্যবস্থা করলেন। এক সময় সেই পাটাতনও গলে পচে শেষ হয়ে গেল। ততদিনে বুলুরা বড় হয়েছে। বুলুর ছোট বোন বীণা কুয়ার পাশে একটা চাঁপা গাছ লাগিয়েছে। সেই গাছও দেখতে দেখতে বড় হয়ে এক চৈত্র মাসে কিছু ফুল ফুটিয়ে ফেলল। আনন্দে বীণা গাছে হেলান দিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল। গাছ সম্ভবত মানুষের ভালবাসা বুঝতে পারে। কাজেই পরের বছর আরো বেশি ফুল ফুটল। তার পরের বছর আরো বেশি। একটা ডাল ঝুঁকে এল কুয়ার ওপর। কে জানে গাছেরও হয়ত নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে ইচ্ছা করে। পুকুর পাড়ের সব গাছ সে কারণেই জলের দিকে ঝুঁকে যায়।
শ্রাবণ মাসের এক মেঘলা দুপুরে মিজান সাহেব তাঁর স্ত্রী এবং দুবছর বয়েসী বুলুকে নিয়ে কল্যাণপুরের এই বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। শ্যাওলা-ধরা পাঁচিলের নোনা-লাগা বাড়ি, চারদিকে ঝোপ ঝাড়। বাড়ির বাঁ দিকে ডোবার মতো আছে। ডোবার চারপাশে ঘন কচুবন। তাঁদের চোখের সামনেই ডোবার পানি কেটে একটা খয়েরি রঙের সাপ চলে গেল।
ফরিদা আঁৎকে উঠে বললেন, কোথায় নিয়ে এলে? এ যে সাপ-খোপের আড্ডা।
মিজান সাহেব বললেন, সব সময় ফালতু কথা বলবে না। ফালতু কথা আমার মোটই ভালো লাগে না।
ফরিদা থমথমে গলায় বললেন, চারদিকে একটা বাড়ি ঘর নেই। ডাকাত মেরে রেখে গেলেও কেউ জানবে না। তুমি থাকবে বাইরে-বাইরে আমি ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে এত বড় বাড়িতে থাকতে পারব না। আমাকে তুমি দেশে পাঠিয়ে দাও।
মিজান সাহেব বললেন, আবার ফালতু কথা শুরু করলে?
এখানে থাকব কী করে?
প্রথম দিনেই বড় যন্ত্রণা শুরু করলে তো?
মিজান সাহেব ভুরু কুঁচকে এমনভাবে তাকালেন যে ফরিদা চুপ করে গেলেন। তবে তাঁর মনটা ভেঙে গেল। প্রথম রাতে একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখে ভয় পেলেন। বারান্দায় হাত ধুতে এসে দেখেন কুয়ার পাশে লম্বা ঘোমটা দিয়ে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বিকট চিৎকার দিলেন। মিজান সাহেব বললেন, ফালতু কথা বলা তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে, জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে আর তুমি বলছ হেন তেন।
এক শ্রাবণ মাসের মেঘলা দুপুরে তিনি এই বাড়িতে ঢুকেছিলেন। আজ আরেক শ্রাবণ মাস। মাঝখানে চব্বিশ বছর পার হয়েছে। তাঁর সংসার বড় হয়েছে। বীণার জন্ম হয়েছে ঢাকা আসার পরের বছর। তার পরের বছর আরেকটি শিশুর জন্ম দিয়ে ফরিদার শরীর ভেঙে গেল। মাথার চুল উঠে গেল, বুকে ফিক ব্যথা। সামান্য কিছুতেই বুক ধড়ফড় করে। ফর্সা মুখ নীল হয়ে যায়।
লম্বা ঘোমটা পরা মেয়েটাকে এখনো ফরিদা হঠাৎ হঠাৎ দেখেন তবে কাউকে কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। ছেলেমেয়েরা শুনলে ভয় পাবে। কী হবে ওদের ভয় দেখিয়ে? তাছাড়া ঐ ঘোমটা দেয়া মেয়ে তো তাঁর কোন ক্ষতি করছে না। এই অশরীরী মেয়ে নিজের মনে আসে। হঠাৎ-হঠাৎ দেখা দিয়ে চলে যায়।
কুয়ার ভেতরের সেই কল কল শব্দ মিজান সাহেবও মাঝে-মাঝে শোনেন। তিনিও কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। সেইসব রাতে তাঁর একেবারেই ঘুম হয় না। বারান্দায় জলচৌকিতে বসে রাত কাটিয়ে দেন।