অশোকের কাছে লুকিয়ে হেরম্ব গভীরভাবে চিন্তা করছিল। চারিদিক বিবেচনা করে ক্রমে ক্রমে তার ধারণা হচ্ছে, এতদিন পরে সুপ্রিয়ার সংস্পর্শে না এলেই সে ভালো করত।
সুপ্রিয়ার কোন শিক্ষাটা বাকি আছে যে ওকে আজ নতুন কিছু শেখানো সম্ভব? জীবনের স্তরে স্তরে সুপ্রিয়া নিজেকে সঞ্চয় করেছে, কারো অনুমতির অপেক্ষা রাখে নি, কারো পরামর্শ নেয় নি। ওর সঙ্গে আজ পেরে উঠবে কে?
খানিক পরে সুপ্রিয়া ফিরে এল। তার এক হাতে ব্র্যান্ডির বোতল অন্য হাতে কাচের গ্লাস!
‘তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। সকালে খাও নি, বড় ডোজ দি, কেমন?’
অশোক কথা বলতে পারে না। একবার মদের বোতলটার দিকে, একবার হেরম্বের মুখের দিকে তাকায়। ভাবে কি সব কাণ্ড সুপ্রিয়ার।
হেরম্ব একটু হাসে। তার একেবারেই বিস্ময় নেই। সুপ্রিয়া যে নারী তাঁর এই প্রমাণটা সে না। দিলেই আশ্চর্য হত। এটুকু বিদ্রোহ না করলে ও তো মরে গেছে!
‘আমায় একটু দিস তো সুপ্রিয়া।’
‘আপনি খাবেন? মদ কিন্তু, খেলে নেশা হয়। মদে শেষে আপনার আসক্তি জন্মে যাবে না তো?’
হেরম্ব তবু হাসে।
‘আসক্তি জন্মলে কি হবে? আমার জন্য মদ যোগাড় করে রাখবে কে সুপ্রিয়া? আমার তো বৌ নেই।‘
এক মিনিটের জন্য হেরম্বকে সুপ্রিয়া ঘৃণা করল বৈকি? রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেছে।
‘না, আপনার বৌ নেই। আপনার বৌ গলায় দড়ি দিয়েছে।‘
‘একথা হেরম্বর জানা ছিল যে, এরকম অসংযম সুপ্রিয়ার জীবনে আরো একবার যদি এসে থাকে। তবে এই নিয়ে দুবার হল। এই সংখ্যাটি সুপ্রিয়ার বাকি জীবনে কখনো দুই থেকে তিনে সুরলি সে বিষয়ে বার্তা রাখতে হয়ে রাজি হবে না। শুধু সুধিয়াকে মারতে পারলে হেরম্ব খুশি হত।
অশোক স্তম্ভিত হয়ে বলল, ‘এসব তুমি কি বলছ?’
কিন্তু সুপ্রিয়ার মুখে আর কথা নেই! কাচের গ্লাসে অশোককে নীরবে খানিকটা মদ ঢেলে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাতে তারা যখন খেতে বসেছে, খুনীকে সঙ্গে করে সিপাহীরা ফিরে এল। হেরম্ব বহুক্ষণ আত্মসংবরণ করেছে। সুপ্রিয়ার মুখ ম্লান। আকাশ ঢেকে মেঘ করে এসেছে। পৃথিবী বায়ুখীন। হেরম্ব বলল, ‘খুনীটার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি না, অশোক? কৌতূহল হচ্ছে।’
অশোক বলল, ‘বেশ তো।’
সুপ্রিয়া চেষ্টা করে বলল, ‘খুনীর সঙ্গে আলাপ করতে চান করবেন, সেজন্য তাড়াতাড়ি করবার দরকার কি! খুনী পালাবে না।’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘না, খুনী পালাবে না। কোমরে দড়ি বাধা হয়েছে, না অশোক?’
‘নিশ্চয়।‘
সুপ্রিয়া অবাক হয়। হেরম্বের কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করে হঠাৎ তার মনে হয়, হেরম্ব নার্ভাস হয়ে পড়েছে, চাল দিচ্ছে, ওর কথার কোনো মানে নেই।
খেয়ে উঠে তারা বাইরের বারান্দায় গেল। একটা কালিপড়া লণ্ঠন জ্বলছে। থামে ঠেস দিয়ে ধূলিধূসরিত দেহে খুনী বসে আছে। যুদ্ধ না করে সে যে পুলিশের কাছে হার মানে নি। সর্বাঙ্গে তার অনেকগুলি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কোমরে বাঁধা দড়িটা ধরে একজন কনষ্টেবল উবু হয়ে বসে ছিল, হেরম্ব ও অশোকের আবির্ভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর নাম কিরে?’
‘বিরসা।’ দুদিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে বুনো জন্তুর মতো; কিন্তু বুনো জন্তু সে নয়, মানুষ। প্রশ্নের জবাব দিয়ে বিরসা আবার ঝিমিয়ে পড়ল।
কনষ্টেবল বলল, ‘আস্নান করনে মাংতা, হুজুর।’
অশোক বলল, ‘এক বালতি পানি, ব্যস!’
হেরাম্বের চিন্তার ধারা অন্যরকম।
‘এমন কাজ করলি কেন বিরসা? বৌকে তাড়িয়ে দিলেই পারতিস।’
বিরসা কিছুই বলল না। বৌয়ের নামোল্লেখে লাল টকটকে চোখ মেলে হেরম্বের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ঝিমোতে শুরু করল। অশোক শান্তভাবে বলল, ‘ওকে ওসব বলে লাভ কি হেরম্ববাবু?’
‘লাভ? লাভ কিছু নেই।’ হেরম্ব একটু ভীরু হাসি হাসল, ‘আমি শুধু জানতে চাইছিলাম ফেথলেস ওয়াইফকে খুন করে মানুষের অনুতাপ হয় কিনা।’
অশোক আরো শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি জানলেন?’
‘জানলাম? অনেক কিছু জানলাম, অশোক। আমার বরাবর সন্দেহ ছিল যে ঈর্ষার বশে যদি কোনো স্বামী স্ত্রীকে খুন করে ফেলতে পারে, তাতে আর যাই হোক, স্বামীটির চরম ভালবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়, এই থিয়োরি হয়তো সত্য নয়। আজ বুঝলাম আমার সন্দেহ সত্যি! ওর তাকাবার রকম দেখলে, অশোকঃ স্ত্রীকে খুন করে তার দাম দেবার ভয়ে ও একেবারে মরে গেছে! এটা ভালবাসার লক্ষণ নয়। ও শুধু খুনী, স্রেফ খুনী; প্রেমিক আমি ওকে বলব না! না, স্ত্রীকে ও ভালবাসত না। স্ত্রী আর একজনকে ভালবাসে বলে যে তাকে খুন করে অথবা কষ্ট দেয়, অবহেলা করে, স্ত্রীকে সে ভালবাসে না। তুমি বুঝতে পার না। অশোক, ভালবাসার বাড়া-কমা নেই? ভালবাসা ধৈৰ্য আর তিতিক্ষা? একটা একটানা উগ্র অনুভূতি হল ভালবাসা, তুমি তাকে বাড়াতে পার না কমাতে পার না? স্ত্রীকে খুন করে ফেলতে চাও কর, কিন্তু তারপর একদিনের জন্য যদি তোমার ভালবাসায় ভঁটা পড়ে, মনে হয় খুন না করলেই হত ভালো, সেইদিন জানবে, ভালবেসে স্ত্রীকে তুমি খুন কর নি, করেছিলে অন্য কারণে। স্ত্রীকে যে ভালবাসে সে অপেক্ষা করে। ভাবে, এখন ও ছেলেমানুষ, আর একজনের স্বপ্ন দেখছে। দেখুক, যৌবনে ওর প্রেম পাব। ভাবে, যৌবন ওকে অন্ধ করে রেখেছে, ও তাই অতীতের অন্ধকারটাই দেখছে। দেখুক, যৌবন চলে গেলে আমি ওকে ভালবাসব। আচ্ছা অশোক, তোমার কি কখনো মনে হয় না যে সুপ্রিয়া আর একজনকে ভালবাসছে এই অবস্থাটাকে মৃত্যু দিয়ে অপরিবর্তনীয় করে দেওয়া বোকামি? কষ্ট দিয়ে আর একজনের প্রতি এই ভালবাসাকে, এই মোহকে প্রবল আর স্থায়ী করে দেওয়া মূর্খামিঃ একি স্ত্রীকে ভালো না বাসার প্রমাণ নয়? এর চেয়ে স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রেখে, তাকে সুখী করে–’