সুপ্রিয়া বলল, ‘কি খেলে?’
‘তুমি যা যা করেছ। খুঁজে-পেতে সব একটা করে খেয়েছি।’
‘তবে তো খুব খেয়েছ!’-বলে সুপ্রিয়া জেরা আরম্ভ করল, ‘সন্দেশ খেয়েছ? না খেলেই ভালো হত, সন্দেশে তোমার অম্বল হয়। রসগোল্লা খেয়েছ? একটা খেলে কেন মোটো? আর দুটো খেলেই হত। আজ ঠিক স্পঞ্জ হয় নি? মালপো খেয়েছ? কেন খেলে? যা সয় না তা খাবার দরকার কি ছিল! এই জন্যেই তো তোমাকে আমি নিজের হাতে খেতে দিই। লোভে পড়ে যা-তা খাবে, শেষে বলবে সোডা দাও।…সরভাজা খাও নি?’
হেরম্ব অশোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাকি স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে পড়েছে, অশোক? শরীর ভালো করার জন্য ব্র্যান্ডি খাও।’
অশোক চমকে বলল, ‘আমি? কই না, খাই না তো। কে বললে খাই?’
হেরম্ব বলল, ‘কেউ না, এমনি কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম।’
সুপ্রিয়া বলল, ‘নাই-বা করতেন। কথাটা জিজ্ঞাসা?’
কিন্তু এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য তার সফল হল না। অনায়াসে প্রসঙ্গান্তর এনে হেরম্ব তার কথাটা চাপা দিয়ে দিল। অশোককে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘খুনী ধরতে গিয়েছিলে শুনলাম? কোথায় খুন হল?’
‘বরকাপাশীতে।’ অশোক সংক্ষেপে জবাব দিল।
‘ধরলে?’
‘ধরেছি। বড় ভুগিয়েছে ব্যাটা। এ গাঁ থেকে সে গাঁ —হয়রান করে মেরেছে! শেষে একটা ঝোঁপের মধ্যে কোণঠাসা করে ধরতে ধরা দিলে।’ অশোক একটু উৎসাহিত হয়ে উঠল। নিজের ব্যবসার কথা বলতে পেলে সকলেই খুশি হয়।’দা নিয়ে খুন করতে উঠেছিল। জমাদার জাপটে না ধরলে আজ একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেত। ব্যাটা কি জোয়ান।’
সুপ্রিয়ার চোখের দিকে একবার স্পষ্টভাবে তাকিয়ে হেরম্ব বলল, ‘কাকে খুন করেছে?’
‘বৌকে। চিরকাল যা হয়ে থাকে–অসময়ে স্বামী বাড়ি ফিরল, লাভার গেল পালিয়ে, বৌ হল খুন। গলাটা একেবারে দুফাক করেও ব্যাটার তৃপ্তি হয় নি। সমস্ত শরীর দা দিয়ে কুপিয়েছে!’
সুপ্রিয়া শিউরে উঠে বলল, ‘মাগো!’
খুনীটা তার স্বামীকে দা নিয়ে কাটতে উঠেছিল শুনে সুপ্রিয়া শব্দ করে নি। স্মরণ করে হেরম্ব একটু ক্ষুব্ধ হল!
‘ফাঁসি হবে?’
অশোক বলল, ‘না! যথেষ্ট প্রোভোকশন ছিল।’
সুপ্রিয়া অস্থির হয়ে বলল, ‘কি আলোচনা আরম্ভ করলো? ওসব কথা থাক বাপু, ভালো লাগে না। খুন, জখম, ফাসি–বলার কি আর কথা নেই?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘তুই দারগার বৌ, খুন জখম ভালো না লাগলে তোর চলবে কেন প্রিয়া?’
‘দারগার বৌ হয়ে কি অপরাধ করেছি? আমি তো দারগা নাই।’
‘কি জানি কি অপরাধ করেছিস। আমি বলতে পারব না। অশোককে জিজ্ঞাসা কর। খুন জখম ভালো না লাগলে পাছে অশোককেও তোর ভালো না লাগে এই ভেবে বলছিলাম সংসারের রাহাজানির ব্যাপারগুলোকে ভালবাসতে শেখ। তুই দাঁড়িয়ে রইলি কেন বল তো, সুপ্রিয়া? অশোকের সামনে তুই দাঁড়িয়ে থাকিস নাকি? এ তো ভালো কথা নয়। হেঁটে এসে তোর নিশ্চয় পা ব্যথা করছে। দাও। হে অশোক, ওকে বসবার অনুমতি দাও। ভালো করে বসে একটা গল্প শোন, সুপ্রিয়া।’
‘শুনব না গল্প।‘
‘আহা শোন না। অশোক ওকে শুনতে বল তো।’
‘শুনব না, শুনব না, শুনব না। হল? গল্প শুনবে–আমি কচি খুঁকি নই।’
হেরম্ব একটা চুরুট বার করে বলল, ‘তবে দেশলাই দে। চুরুট খাই।’
অশোক অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। সে যেন ঘুম ভেঙে উঠে বলল, ‘একি কাণ্ড! আপনারা যে রীতিমতো ঝগড়া করছেন!’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘না। সুপ্রিয়াকে একটু রাগাচ্ছিলাম। ছেলেবেলায় গল্প বলুন, গল্প বলুন বলে এত বিরক্ত করত——কোথায় যাচ্ছিস সুপ্রিয়া?’
‘রান্নার ব্যবস্থা একটু দেখি?’–বলে সুপ্রিয়া চলে গেল।
হেরম্ব বলল, ‘চটেছে।’
অশোক বলল, ‘ঠাট্টা তামাশা একেবারে সইতে পারে না।’ একটু ইতস্তত করে যোগ দিল, ‘সেন্স অফ হিউমার বড় কম।’
হেরম্ব বলল, ‘তাই নাকি!’
‘ওকে আমি এত ভয় করি শুনলে আপনি হাসবেন।’
‘ওকে কে ভয় করে না, অশোক? এমন একগুঁয়ে জেদী মেয়ে সংসারে নেই। একবার যা ধরবে শেষ না দেখে ছাড়বে না। ওকে বোধহয় মেরে ফেলা যায়। কিন্তু জেদ ছাড়ানো যায় না।’
‘ঠিক। অবিকল মিলে যাচ্ছে।’
হেরম্ব শঙ্কিত হয়ে বলল, ‘মিলে যাচ্ছে কি রকম?’
‘আপনি জানেন না? বিয়ের পর এক বছর ধরে চেষ্টা করেও ওকে কিছুতে এখানে আনতে পারি নি। শেষবার আনতে গেলে ওর কাকা বুঝি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, না যাস্ তো আমার বাড়িতে থাকতে পাবি নে। আমারও একটু অন্যায় হয়েছিল। —রাগারগি আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। যাই হোক, আমার সঙ্গে সেই যে এল তারপর পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনও ওর কোকা ওকে নিয়ে যেতে পারে নি। বলে, যাব না বলে এসেছি, যাব কেন?’
‘প্রথমে এখানে আসতে চায় নি জানতাম। আমিও অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু আসবার সময় ফিরে যাবে না বলে এসেছিল এ খবর তো পাইনি।’
‘ছেলেমানুষ রাগের মাথায় কি বলেছে না বলেছে কে খেয়াল করে রেখেছিল। ও যে ফিরে যাবে না প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল, ও ছাড়া আর কারুর হয়তো সেকথা এখন মনেও নেই। ওর কাকা এখনো দুঃখ করে আমাকে চিঠি লেখেন। চিঠি পড়ে। কাঁদে, কিন্তু একদিনের জন্য যেতে রাজি হয় না।‘
হেরম্ব একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল, তুমিই ওকে পাঠাও না।’
অশোক, বিমৰ্ষভাবে হাসল। বলল, ‘ককার চিঠির যে সব জবাব আমাকে দিয়ে লিখিয়েছে, তাতে আপনি কেন, সকলেরই ওরকম ধারণা হবে। কথাটা প্ৰকাশ করবেন না, দাদা। ওদিকে কাকা মনে ব্যথা পাবেন, এদিকে আপনাকে বলার জন্য আমাকে টিকতে দেবে না। রাগের মাথায় মত বদলে কাকার কাছে চললাম, তোমার কাছে আর আসব না বলে বিদায় নিলে তো বিপদেই পড়ে যাব।’