না বাপু, এমন করে একটা দিনও আমি থাকতে পারব না।
কড়াইয়ের ফেনার তলে অদৃশ্যপ্রায় রসগোল্লাগুলির দিকে তাকিয়ে ভেবেছে আমি ওর সঙ্গে চলে যাব। কিছুতেই আমাকে ফেলে রেখে যেতে দেব না। বলব আপনার জন্য না হোক, আমার জন্যই আমাকে নিয়ে চলুন। না নিয়ে গেলে আমি যে জীবনে প্রথমবার ওর অবাধ্য হয়ে বিষ খেয়ে মরে যাব এ কথাটাও ওকে আমি জানিয়ে দেব।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে হেরম্বের সঙ্গে শুকনো ঘাসে ঢাকা মাঠে হাঁটতে হাঁটতে সুপ্রিয়া তার এই প্রতিজ্ঞ স্মরণ করে মূক হয়ে গিয়েছিল। এই নিস্তেজ আত্মবিস্মৃত মানুষটার সঙ্গে গিয়ে তার লাভ কি হবে? ও তো ভুলে গিয়েছে। ও আর না চায় সুপ্রিয়ার দেহ, না চায় তার মন। সংসারের টানে সুপ্রিয়া ওর কাছ থেকে ভেসে গিয়েছে। ওর আর ইচ্ছা নয় সাঁতরে সে ফিরে আসে।
হে ভগবান! জগতে এমন ব্যাপার ঘটে কি করে!
মাটির স্থির তরঙ্গের মতো একটা উঁচু জায়গায় পৌঁছে সুপ্রিয়া অস্ফুট স্বরে বলল, ‘একটু বসি।‘
থানার মিটমিটে আলোটির দিকে মুখ করে তারা বসল।
সুপ্রিয়া হঠাৎ বলল, ‘বৌয়ের কথা বলতে আপনার কি কষ্ট হয়?’
হেরম্ব পাশবিক নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জবাব দিল, ‘না।’
‘বৌ গলায় দড়ি দিয়েছিল। কেন?’
‘জানি না।’
চারিদিকে অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হয়ে আসছিল। রূপাইকুড়া গ্রামে দু-একটি আলোকবিন্দু সঞ্চরণ করছে। বছরে দুবার আকাশে তারা-খসার মরসুম আসে, এখন আর শীতকালে। আকাশে অর্ধেক তারা উঠবার আগেই থানার পিছনে একটা তারা খসে পড়ল।
হেরম্বের সংক্ষিপ্ত জবাবটি মনে মনে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে সুপ্রিয়া বলল, ‘দাদার চিঠিতে যখন জানলাম বৌ ওরকমভাবে মরেছে, প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারি নি। জগতে এত লোক থাকতে আপনার বৌ গলায় দড়ি দেবে এ যেন ভাবাও যায় না।’
‘আমার মতো লোকের বৌয়েরাই গলায় দড়ি দেয় সুপ্রিয়া। আমি হলাম জগতের সেরা পাষণ্ড। তুই ছেলেমানুষ —’
‘আবার ও কথা!’
হেরম্ব এবার একটু শব্দ করেই হাসল।
‘ছেলেমানুষ বললে তোরা রাগ করিস, এদিকে বয়স কমাবার চেষ্টার কামাই নেই। তোরা-’
‘এসব বিশ্ৰী পচা ঠাট্টা শুনতে ভালো লাগছে না, হেরম্ববাবু।’
‘সেটা আশ্চৰ্য নয় সুপ্রিয়া।’ হেরম্ব একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সুপ্রিয়া বলল, ‘তারপর বলুন।’
হেরম্ব বলল, ‘আমি জগতের সেরা পাষণ্ড, একথা স্বীকার করার পর আর কি বলার থাকে মানুষের? গলায় দড়ি না দিলে উমা ক্ষেপে যেত। প্রকৃতপক্ষে, একটু ক্ষেপে গিয়েই সে গলায় দড়ি দিয়েছিল।‘
সুপ্রিয়া রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার কথা শুনে?’
‘তোর কথা আমি ওকে কিছুই বলি নি।’
‘তবে? কি জন্যে। তবে ও অমন কাজ করল! আমি ওর সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছি, হেরম্ববাবু। দাদা লিখেছেন, অমন শান্ত ভালো মেয়ে আর হয় না। শুধু শুধু সে অমন কাজ করতে যাবে কেন?’
‘তোর দাদা জগতের সব খবর রাখে।‘
‘আশ্চর্য মানুষ আপনি!’ সুপ্রিয়া আর কথা খুঁজে পেল না। হেরম্বের কাছে কথার অভাব তার চিরন্তন। হেরম্বের কাছে এলে মনের কথা ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়োজন তার শেষ হয়ে যায়। হেরম্ব। যেন তার ভাবনা শুনতে পাবে। কাছে বসে ভেবে গেলেই হল। প্রথম প্ৰেমে-পড়া মেয়েদের এই ভ্রান্ত অবস্থাটি সুপ্রিয়া এখনো একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারে নি। হাজার প্রশ্নে মন ভারি করে সে তাই নীরবে বসে রইল।
উমা তারই জন্য আত্মহত্যা করেছে এই ছিল এতকাল তার ধারণা। স্বামী মনপ্রাণ দিয়ে আর একজনকে ভালবাসে–তাকে ভালবাসে না, এটা বেচারির সহ্য হয় নি। আরেকজনের তরে, প্রেমে তলিয়ে যাওয়া স্বামীকে ছেড়ে সে তাই মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছে। এই ধারণা হেরম্বের কথায় ভেঙে যেতে সুপ্রিয়া বিহ্বল হয়ে গেল। হেরম্ব যে তাকে ভালবাসে উমার আত্মহত্যা ছিল তার প্রমাণ। মৃত্যুর মতো অখণ্ড অপরিবর্তনীয় নিঃসংশয় প্রমাণ। এই প্রমাণের বাঁধ অপসারিত হয়ে যেতে যে সন্দেহ ও আত্মগ্লানির বন্যা এল, সুপ্রিয়া তাতে আর থাই পেল না। তার মনে হল, সারাদিনের ব্যর্থ চেষ্টার পর এতক্ষণে হেরম্ব তাকে আশ্ৰয়াচুত করে দুঃখ হতাশার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে। জীবনে আর তার কিছুই রইল না। একদিনের ভুল আর বাকি দিনগুলির জন্যে সেই ভুলের উপলব্ধি—এই দুটি পরিচ্ছেদই তার জীবনী। যে জীবনকে সে মহাকাব্য বলে জেনে রেখেছিল। সে একটা সাধারণ কবিতাও নয়।
থানায় পৌঁছে তারা দেখল, অশোক ফিরে এসে স্নান সমাপ্ত করে বিশ্রাম করছে।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কতক্ষণ ফিরেছ, অশোক?’
‘আপনারা বেরিয়ে যাবার একটু পরেই।’
সুপ্রিয়া অনুযোগ দিয়ে বলল, ‘আমায় ডেকে পাঠালে না কেন? আমরা ওই সামনের মাঠে ছিলাম। এখান থেকে দেখা যায়।’
অশোক হেসে বলল, ‘কি বলে ডেকে পাঠােতাম? আমি বাড়ি এসেছি, তুমি চাটু করে বাড়ি চলে। এস? তার চেয়ে দিব্যি স্নানটান করে বিশ্রাম করছিলাম। গা হাত, জান গো, ব্যথা হয়ে গেছে।’
‘আহা, তা হবে না? সারাটা দিন যে ঘোড়ার পিঠে কাটল। খাও নি কিছু? জানি খাও নি, আমি এসে না দিলে খাবে–’
অশোক অপরাধীর মতো বলল, ‘খেয়েছি, সুপ্রিয়া। এমন খিদে পেয়েছিল।–’
হেরম্ব লক্ষ করল, সুপ্রিয়ার মুখ প্রথমে একটু কালো হয়ে শেষে লালিমায় পরিবর্তিত হয়ে গেল। চাকরি ছাড়া স্বামীকে আর সব বিষয়েই সে যে তার মুখাপেক্ষী করে রেখেছে, হেরন্ধের কাছে তা প্রকাশ হয়ে গেল। একদিন ক্ষুধার সময় তার অপেক্ষায় বসে না থেকে পেট ভরালে অশোকের যদি অপরাধ হয়, স্ত্রীর কাছে সে অনেকটা শিশুত্বই অর্জন করেছে বলতে হবে। আগাগোড়া স্ত্রীর মুন যোগানোর এই আদর্শ বজায় রেখে অশোক দিন কাটায় কি করে ভেবে হেরে অবাক হয়ে রইল।