সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে হেরম্ব দেখল। আয়নার সামনে সুপ্রিয়া চুলবাধা শেষ করে এনেছে। সে টের পেল, সুপ্রিয়ার একটি আশা সে পূর্ণ করেছে। প্রসাধন শেষ হবার আগে ঘুম ভেঙে সে তাকে দেখবে সুপ্রিয়ার এই কামনা হেরম্বকে রীতিমতো বিস্মিত করে দিল।
‘চুলের জট ছাড়াতে কান্না আসছিল, হেরম্ববাবু। কপাল ভালো, তাই একটু আগে আপনার ঘুম ভাঙে নি। তখন আমার মুখ দেখলে আর এক মিনিট এ বাড়িতে থাকতে রাজি হতেন না।’
দুহাতের তালু একত্র করে মাথার পিছনে রেখে হেরম্ব বলল, ‘ডেকে তোলা উচিত ছিল। চুলের জট ছাড়াবার সময় তোদের মুখভঙ্গি দেখতে আমার বড় ভালো লাগে, সুপ্রিয়া!’
‘সৃষ্টিছাড়া ভালো লাগা নিয়েই তো করবার আপনার।’
সুপ্রিয়া তাড়াতাড়ি খোঁপা বেঁধে ফেলল। আয়নায় একবার পরীক্ষকের দৃষ্টিতে নিজের মুখখানা দেখে নিয়ে প্রসাধনে যবনিকাপাত করল।
বলল, ‘আর ঘরে কেন? বাইরে বসে চা খাবেন চলুন। এর মধ্যে চারিদিক জুড়িয়ে গিয়ে ঝিরঝির বাতাস বইছে।‘
‘রাত্রে এখানে ঠাণ্ডা পড়ে, না?’
সুপ্রিয়া হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘গরম কমে, ঠাণ্ডা পড়ে না। তবে খুব বাতাস বয়–ওই যে ঝাউগাছগুলি দেখছেন? সমস্ত রাত শী শী করে ডাকবে, শুনতে পাবেন।’
হেরম্ব ক্ষণিকের জন্য মুগ্ধ হয়ে গেল।
‘ঝাউগাছের কাছ থেকে বেড়িয়ে আসি চল, সুপ্রিয়া।’
‘যাবেন?’ সুপ্রিয়া এক মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে উঠল—’তবে উঠুন, উঠে শিগগির তৈরি হয়ে নিন। আমি চাটু করে চা করে ফেলছি। উঠুন না।’
হেরম্ব প্রশান্তভাবে শুয়ে রইল। উঠবার তার কোনো তাড়াই আর দেখা গেল না। আলস্যের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে স্তিমিত চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘আলসেমি লাগছে সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া ক্ষুন্ন হয়ে বলল, ‘যাবেন বললেন যে?’
‘যাব বললাম বটে কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম, ঝাউগাছ দূর থেকেই ভালো দেখায়।’
‘অন্যদিকে চলুন। তবে? চলুন দুজনে মাঠে খানিকটা হেঁটে আসি। যাবেন বলেছেন যখন, আপনাকে যেতে হবেই হেরম্ববাবু। উঠুন। দশ গোনার মধ্যে না উঠলে হাত ধরে টেনে তুলে দেবী।‘
হাত ধরে টেনে তোলার ইচ্ছাটা সুপ্রিয়ার আকস্মিক নয়, হাত ধরে টেনে তোেলবার সুযোগটা হেরম্ব তাকে দেবে এ আশাও সুপ্রিয়া করছিল। রহস্যের ছলে এ তো তুচ্ছ, সামান্য দান। কিন্তু এটুকু বুঝবার মতো নিবিড় মনোযোগ সুপ্রিয়ার প্রতি হেরম্ব বজায় রাখতে পারে নি। সুপ্রিয়ার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে বিছানায় উঠে বসল।
সুপ্রিয়াকে চেষ্টা করে চোখের জল নিবারণ করতে হল। তার যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে পদে পদে ব্যথা না পেয়ে তার উপায় ছিল না। গোধূলিলগ্নে নির্জন তরঙ্গায়িত প্রান্তরে তার সঙ্গে পাশাপাশি বেড়াতে যাওয়া হেরন্থের কাম্য নয় সন্দেহ করে, কাম্য হলেও একটা তুচ্ছ খেয়ালের বশে বেড়াতে যাওয়ার উৎসাহ সে সত্য সত্যই দমন করে ফেলেছে নিশ্চিত জেনে, সুপ্রিয়া কম আহত হয় নি। তবু হৃদয়কে হেরম্ব জোর করে নিয়ন্ত্রিত করছে এই ধারণা সুপ্রিয়াকে সন্তুনা দিচ্ছিল। কিন্তু সে যে ছুতো করে হেরম্বের হাত ধরে টেনে তুলতে চায় এটা হেরম্ব খেয়াল পর্যন্ত করতে পারল না দেখে নিজেকে তার অপমানিত ও অবহেলিত মনে হতে লাগল। সে যেন বুঝতে পারুল, হেরাম্বের মন থেকে সে মিলিয়ে গেছে। একটা কর্তব্য-বুদ্ধির, একটা মোটা সাংসারিক প্রতিকারস্পৃহার আশ্রয় ছাড়া হেরম্বের কোনো মনোবৃত্তিই আর তাকে নিয়ে ব্যাপৃত হয়ে নেই।
শেষ পর্যন্ত মাঠে হেরম্ব তাকে বেড়াতে নিয়ে গেল, কিন্তু বেড়ানো উপভোগ করার ক্ষমতা সুপ্রিয়ার আর ছিল না। সমস্ত দুপুরাটা প্রকৃতির গ্ৰীষ্ম আর উনানের ধীেয়া সহ্য করে সে কল্পনার জাল বুনেছে। ভেবেছে, পথের গ্লানি কেটে গেলে বিকালে শত অনিচ্ছাতেও নিজেকে ও প্রকাশ না করে পারবে না। নিজের অজ্ঞাতেই ও কত কথা বলবে, কত ভুল করবে, কত সময় অন্যমনে আমার দিকে চাইবে। ও টেরও পাবে না। ওর কোন কথাটি কুড়িয়ে, কোন ভুলটি ধরে, কোন চাউনির মানে বুঝে ওকে আমি চিনে ফেলেছি। সুপ্রিয়া আরো ভেবেছে, আমি এখন বড় হয়েছি। পাঁচ বছর ধরে ভেবে ভেবে আমি বুঝতে পেরেছি। পৃথিবীতে একটা ব্যাপার হয় না। বেশ মোটা করে ভালবাসা বুঝিয়ে না দিলে–
সারা দুপুর সুপ্রিয়া এই কথা ভেবেছে। ভেবেছে আমার এই শরীরটা এত সুন্দর নয় যে, শুধু চোখে দেখার সান্নিধ্যে কেউ খুশি হয়। ওর মনের বাজে খেয়ালটা নষ্ট করে দিতে হলে আমাকে লজ্জা একটু কমাতে হবে। ওর কি, কাল চলে গেলে মস্ত একটা ত্যাগ করার গৌরব নিয়েই বাকি জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দেবে। সর্বনাশ! আমার। কাব্য নিয়ে থাকলে আমার চলবে কেন? আমি যে একটি দিনের জন্য সুখ পেলাম না, সারাদিন আমার যে কিছু ভালো লাগে না, কিছুই ভালো লাগে না–
কাল ও জন্মের মতো চলে গেলে বেঁচে থেকে আমি কি করব? এতদিন আশায় আশায় কাটিয়েও যে কষ্টটা আমি পেয়েছি, ও তার কিছু বুঝবে! ছাই সংসার, ছাই ভালোমন্দা ছাই আমার মঙ্গল-অমঙ্গল! একজনের অদর্শন সইতে না পেরে আমার যদি শুধু অসহ্য যন্ত্রণাই হতে থাকে, জগতে কিসে তবে আমার মঙ্গল হওয়া সম্ভব শুনি? পাঁচ বছর পরীক্ষা করেই তো বোঝা গেল এসব আমার পোষাবে না। কলের মতো হাত-পা নেড়েছি, শুয়েছি, বসেছি, হেসেছি। পর্যন্ত; কিন্তু আমি তো জানি কি করে এতকাল আমার কেটেছে, দিনের মধ্যে কতবার আমার মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে সাধ গিয়েছে।