সে জবাব দেবে কি? স্বামীর মনের জোরে সন্দেহ প্ৰকাশ করবে? তার স্বাস্থ্য ভালো করার দরকার নেই বলে আব্দার ধরবে? অশোক ধমকে উঠলে তার মুখখানা হেরম্ব যেন তখন দেখে যায়।
গরমে, আগুনের তাতে, সুপ্রিয়া এতক্ষণে ঘোমে উঠেছে। উঠানে চনাচনে রোদ। একটু বাতাস গায়ে লাগাবার জন্য দরজার কাছে গিয়ে সুপ্রিয়া দেহকতে পেল, হেরম্ব শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনের মাঝে উঠানের ব্যবধান ভরে ঝাজাল কড়া রোদটা সুপ্রিয়ার কাছে রূপকের মতো ঠেকাল।
বারান্দা থেকেই হেরম্ব বলল, ‘এত গরমে তোর না। রাধলেও চলবে, সুপ্রিয়া। পাড়েকে ছেড়ে দিয়ে চলে আয়, যা পারে ওই করবে।‘
সুপ্রিয়া কথা বলল না। আঁচলে মুখ মুছে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
হেরম্ব বলল, ‘আমাকে চা দিলি না যে?
‘এত গরমে এক শ বার চা খেতে হবে না।’
‘এক গেলাস জল দে। তবে।‘
হেরম্বকে তৃষ্ণার্তা জেনে সুপ্রিয়ার সেবাবৃত্তি জাগ্রত হয়ে উঠল।
‘শরবত করে দেব? লেবুর শরবত?’
হেরম্ব আগ্রহ জানিয়ে বলল, ‘দে, তাই দে।’
আহত, উত্তপ্ত ও ঘর্মাক্ত সুপ্রিয়ার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নেবার সময় এক মুহূর্তের জন্য হেরম্বের মনে হয় হয়তো সত্য সত্যই মেয়েদের মঙ্গলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পুরুষেরা গোড়াতেই কোথাও একটা গলদ বাধিয়ে বসে আছে, যে জন্য ওদের মনের শৈশব কোনোদিনই ঘুচিতে চায় না। ঘুণ যদি ধরে তো একেবারে কাঁচা মনেই ধরে, নইলে ওরা আজন্ম শিশু। জীবন-সাগরের তীরে বালি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করে ওরা খুশি থাকবে, সমুদ্রের সঙ্গে তাদের সে কীর্তির তুলনা কখনো করে না। ডাবের জলে ডাবের শীসে জগতের ক্ষুধা-তৃষ্ণ দূর হয় চিরদিন এই থাকত ওদের ধারণা, জগতের ক্ষুধাও ওরা বুঝবে না, তৃষ্ণর প্রকৃতিও জানবে না।
শরবত পান করে হেরম্ব বলল, ‘কাল ফিট হয়েছিল, আজ আবার রাধতে গেলি কেন?’
‘বাড়িতে অতিথি, রাধব না? অতিথি খাবে কি?’
‘অতিথি দাইচিড়ে দিয়ে ফলার করবে।’
‘অতিথির অন্ত দরদ দেখিয়ে কাজ নেই।’
সুপ্রিয়ার মুখের মেঘ আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল। সে ভাবতে আরম্ভ করেছিল যে, হেরম্ব খেয়ালি মানুষ, মনের খেয়ালে ও যদি একটা অদ্ভুত কিছু করতে চায়, রাগ করে আর লাভ কি হবে? যে উদ্দেশ্যে যে মনোভাব নিয়েই ও এসে থাক, সে বিনা প্রতিবাদে। ওকে গ্ৰহণ করবে। নিজের সুখ-দুঃখ মান-অভিমানের কথাটা একেবারেই ভাববে না। বড় ভাইয়ের মতো ও যদি তাকেশাসন করে, ছোট বোনের মতো সে নীরবে শাসিত হবে। ভ্ৰান্ত কল্যাণকামীর মতো ও যদি তার মনে ব্যথা দেয়, মুখ বুজে। সে ব্যথিত হবে। ও যদি তার চোখের জল দেখতে চায়, দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঢেলে ওকে সে চোখের জল দেখাবে। স্বপ্নহীন মাধুৰ্যহীন রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে তাকে যদি আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেখতে চায়, পাকা গিনির মতো ব্যবহার করে ওকে সে তাক লাগিয়ে দেবে।
হেরম্বের নিদ্রালস প্রভাতটি অতঃপর, সুপ্রিয়ার এই গোপন প্রতিজ্ঞার ফলাফলে ক্ষুব্ধ ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। সহসা সুপ্রিয়া যেন তার কাছে একটা দুৰ্বোধ্য রহস্যের আবরণ নিয়েছে বিদায়কামী কচের কাছে দেবযানীর অভিশাপের মতো সুপ্রিয়ার আকস্মিক ও অভিনব সহজ হাসিখুশির ভাবটা হেরম্বের কাছে দুর্বলের বিশ্ৰী প্রতিশোধ নেওয়ার মতো ঠেকতে লাগল। মনে হল, ইদারার জলের মতো ঠাণ্ডা মেয়েটা হঠাৎ বরফ হয়ে গেছে। স্নিগ্ধতা দেখালে আরো জমাট বাঁধছে, রূঢ়তার উত্তাপে বিনা বাক্যব্যয়ে গলতে আরম্ভ করে দিচ্ছে। কিন্তু গ্ৰহণ করছে না কিছুই।
সুপ্রিয়ার রান্না শেষ হতে বারটা বাজল। ফিট হতে শুরু হওয়ার পর থেকে তার চোখের কোলে নিষ্প্রভ কাজলের মতো একটা কালিমার ছাপা পড়েছিল। এই আবেষ্টনীর মধ্যে চোখ দুটি আজকাল আরো বেশি উজ্জ্বল দেখায়। এখন, এই গরমে এতক্ষণ কাঠের উনানে রান্না করার ফলে তার সমস্ত মুখ মলিন নিরুজ্জ্বল হয়ে গেছে। হেরম্ব আর একবার স্নান করবে। কিনা জিজ্ঞাসা করতে এলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেরম্ব ব্যথিত হল। একধার থেকে কেবল রান্না করে যাওয়ার পাগলামি মেয়েদের কেন আসে হেরম্বের তা অজানা নয়! আরো অনেককেই সে এ নেশায় মেতে থাকতে দেখেছে। সুপ্রিয়ার মতো তাদেরও এমনি রান্নার ঝোঁক চাপে, রেঁধে রেঁধে আধমরা হয়ে তারা খুশি হয়।
অথচ তাদের সঙ্গে, যারা ভাববার উপর্যুক্ত মন থেকে বঞ্চিত, সুপ্রিয়ার একটা অতিবড় মৌলিক পার্থক্য আছে। ওর এত রান্না করাকে হেরম্ব কোনোমতেই সমর্থন করতে পারল না।
বারান্দায় দাঁড়ালে বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে বহুদূর অবধি প্রান্তর চোখে পড়ে। মাঠ থেকে এখন আগুনের হালকা উঠছে। খানিক তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়।
হেরম্ব বলল, ‘বার বার স্নান করিয়ে আমাকে ঠাণ্ডা করতে চাস, তুই যে গরমে গলে গেলি নিজে?’
সুপ্রিয়া এখনো হাসল, ‘গলে গেলাম? ননীর পুতুল নাকি?’
হেরম্ব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘হাসিস নে। তুই কি বলবি জানি, তবু তোকে বলে রাখি, শরীর ভালো রাখার চেয়ে বড় কাজ মানুষের নেই। শরীর ভালো না থাকলে মানুষ ভাবুক হয়, দুঃখ বেদনা কল্পনা করে, ভাবে জীবনটা শুধু ফাঁকি। বদহজম আর ভালবাসার লক্ষণগুলি যে একরকম তা বোধহয় তুই জানিস নে? —’
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়া আনমনে হেরম্বের মুখে স্বাস্থ্যতত্ত্ব সম্পৰ্কীয় উপদেশ শুনল। কিন্তু তার একটি কথাতেও সায় দিল না।