আনন্দ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তাই ভালো। নাচই ভালো। উঃ ভাগ্যে তুমি বললে! নাচতে পেলে আমার মনের সব ময়লা কেটে যাবে, সব কষ্ট দূর হবে।’
আনন্দ টান দিয়ে আলগা খোঁপা খুলে ফেলল।—’চল উঠোনে যাই। আজ তোমাকে এমন নাচ দেখাব তুমি যা জীবনে কখনো দেখ নি। দেখ তোমার রক্ত টগবগা করে ফুটবে। এই দেখ, আমার পা চঞ্চল হয়ে উঠেছে।’
আনন্দের এই সংক্রামক উন্মাদনা আনন্দের নৃত্যপিপাসু চরণের মতো হেরম্বের বুকের রক্তকে চঞ্চল করে দিল। শক্ত করে পরস্পরের হাত ধরে তারা খোলা উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। সকালে ঝড়বৃষ্টির পর যে রোদ উঠেছিল তাতে উঠান শুকিয়ে গিয়েছিল, তবু উঠোনভরা বর্ষাকালের বড় বড় তৃণের স্পর্শসিক্ত ও শীতল। আনন্দের নাচের জন্যই নিশীথ আকাশের নিচে এই সরস কোমল গালিচা বিছানো আছে।
‘কি নাচ নাচবে, আনন্দ? চন্দ্ৰকলা?’
‘না। সে তো পূর্ণিমার নাচ। আজ অন্য নাচ নাচব।’
‘নাচের নাম নেই?’
আছে বৈকি। পরীনৃত্য। আকাশের পরীরা এই নাচ নাচে। কিন্তু আলো চাই যে?’
‘আলো জ্বালাচ্ছি, আনন্দ।’
ঘরে ঘরে অনুসন্ধান করে হেরম্ব তিনটি লণ্ঠন আর একটি ডিাবরি নিয়ে এল। আলোগুলি জ্বেলে সে ফাঁকে ফাঁকে বসিয়ে দিল।
আনন্দ বলল, ‘এ আলোতে হবে না। আরো আলো চাই। তুমি এক কাজ কর, রান্নাঘরে কাঠ। আছে, কাঠ এনে একটা ধুনি জ্বেলে দাও।’
‘ধুনি আনন্দ?’
আনন্দ অধীর হয়ে বলল, ‘কোন দেরি করছ? কথা কইতে আমার ভালো লাগছে না। ঝোক চলে গেলে কি করে নাচব?’
আনন্দ উত্তেজনায় থারথার করে কাঁপছিল। তার মুখ দেখে হেরম্বের একটু ভয় হল! ক’দিন থেকে যে বিষণ্ণতা আনন্দের মুখে আশ্রয় নিয়েছিল তার চিহ্নও নেই, প্রাণের ও পুলকের উচ্ছস তার চোখে-মুখে ফুটে বার হচ্ছে! দাঁড়িয়ে আনন্দকে দেখবার সাহস হেরম্বের হল না। রান্নাঘর থেকে সে এক বোঝা কাঠ নিয়ে এল।
আনন্দ বলল, ‘আরো আন, যত আছে সব।’
‘আর কি হবে?’
‘নিয়ে এস, আরো লাগবে। যত আলো হবে নাচ তত জমবে যে। পরী কি অন্ধকারে নাচে?’
রান্নাঘরে যত কাঠ ছিল বয়ে এনে হেরম্ব উঠানে জমা করল। আনন্দের মুখে আজ মিনতি নেই, অনুরোধ নেই, সে আদেশ দিচ্ছে। মনে মনে ভীত হয়ে উঠলেও প্রতিবাদ করার ইচ্ছা হেরম্ব দমন করল। আনন্দ যা বলল নীরবে সে তাই পালন করে গেল। মালতীর ঘর থেকে এক টিন ঘি এনে কাঠের স্তুপে ঢেলে দিয়ে কিন্তু সে চুপ করে থাকতে পারল না।
‘ভয়ানক আগুন হবে, আনন্দ!’
আনন্দ সংক্ষেপে বলল, ‘হোক।’
‘বাড়িতে আগুন লেগেছে ভেবে লোক হয়তো ছুটে আসবে।’
‘এদিকে লোক কোথায়? আর আসে তো আসবে। দাও, এবার জ্বেলে দাও।’
আগুন ধরিয়ে হেরম্ব আনন্দের পাশে এসে দাঁড়াল। বিরাট যজ্ঞােনলের মতো ঘূতসিক্ত কষ্ঠের স্তুপ হু হু করে জ্বলে উঠল। সমস্ত উঠোন সোনালি আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘এই না হলে আলো!’
ওদিকের প্রাচীর, এদিকের বাড়ি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ঘি-পোড়া গন্ধ বাতাসে ভেসে কতদূরে গিয়ে পৌঁছল। কেউ জানে না। হেরম্ব আনন্দের একটা হাত চেপে ধরল।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আনন্দ বলল, ‘তুমি সিঁড়িতে বসে নাচ দেখ। আমায় ডেক না, আমার সঙ্গে কথা বোলো না।’
হেরম্ব সিঁড়িতে গিয়ে বসল। আনন্দ আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হেরম্বের মনে হল আগুনের সে এত কাছে দাঁড়িয়েছে যে তার চোখের সামনে সে বুঝি ঝলসে পুড়ে যাবে। কিন্তু নৃত্যের বিপুল আয়োজন, আনন্দের উন্মত্ত উল্লাস তাকে মূক করে দিয়েছিল। আগুনের তাপে আনন্দের কষ্ট হচ্ছে বুঝেও সে কাঠের পুতুলের মতো বসে রইল।
খানিকক্ষণ আগুনের সান্নিধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একে একে কাপড়জামা খুলে আনন্দ অর্ঘ্যের মতো আগুনে সমৰ্পণ করে দিল। তার গলায় সোনার হারে তাবিজ ছিল, বাহুতে তুলসীর মালা ছিল, হাতে ছিল সোনার চুড়ি। একে একে খুলে তাও সে আগুনে ফেলে দিল। নিরাবরণ ও নিরাভরণ হয়ে সে যে কি নৃত্য আজ দেখাবে হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারল না।
আনন্দ ধীরে ধীরে আগুনকে প্রদক্ষিণ করতে আরম্ভ করল। অতি মৃদু তার গতি, কিন্তু চোখের পলকে ছন্দ চোখে পড়ে। এও সেই চন্দ্ৰকলা নাচেরই ছন্দ। সে নাচে তিল তিল করে আনন্দের দেহে জীবনের সঞ্চার হয়েছিল, আজ তেমনি ক্রমপদ্ধতিতে সে গতি সঞ্চয় করেছে। গতির সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের লীলাচাঞ্চল্যের সমন্বয়, যার জন্ম চোখে পড়ে না, শুধু মনে হয় সমগ্র নৃত্যের রূপ ক্রমে ক্রমে পরিস্ফুট হচ্ছে। প্রথমে আনন্দের দুটি হাত দেহের সঙ্গে মিশে ছিল, হাত দুটি যখন আগুনের কম্পিত আলোয় তরঙ্গ তুলে তুলে দুই দিগন্তের দিকে প্রসারিত হয়ে গেল, তখন আনন্দের পরিক্রমা অত্যন্ত দ্রুত হয়ে উঠেছে। এখন যে তার নৃত্যের পরিপূর্ণ বিকাশ, এই নৃত্যকে যে না চেনে তারও তা বোঝা কঠিন নয়। হেরম্ব বড় আরাম বোধ। করল। তার অশান্তি ও উদ্বেগ, শ্ৰান্তি ও জড়তা মিলিয়ে গিয়ে পরিতৃপ্তিতে সে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। : আনন্দের প্রথম নৃত্যের শেষে মন্দিরের সামনে সে প্রথম যে অলৌকিক অনুভূতির স্বাদ পেয়েছিল, আবার, তার আবির্ভাবের সম্ভাবনায় হেরম্বের দেহ হাল্কা, মন প্রশান্ত হয়ে গেল।
কিন্তু এবারো অকস্মাৎ আনন্দের নৃত্য থেমে গেল। আগুনের আরো নিকটে সে থমকে দাঁড়াল। আগুন। এখন তার মাথা ছাড়িয়ে আরো উঁচুতে উঠেছে, আনন্দকেও মনে হচ্ছে আগুনের শিখা! পরীক্ষণে আনন্দ কাত হয়ে সেই বিপুল ব্যাপক যজ্ঞানলে ঢলে পড়ল।