হেরম্ব চুপ করে থাকে। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ বাতাসের বেগে ছুটে চলছিল। এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ডাক শোনা যায়।
‘আনন্দকে দেখা হেরম্ব। দুঃখ দিও না ওকে। তোমার মাস্টারমশায়ের হাতে আমার যে দুর্দশী হয়েছে ওরা যেন সে রকম না হয়। টাকা-পয়সা যা রোজগার করেছি। সব রেখে গেলাম। আমার ঘরে যে কাঠের সিন্দুক আছে, তাতে সোনার গয়না আর রূপার বাসন কোসন পাবে। সবচেয়ে বড় চাবিটা সিন্দুকের তালার। মন্দিরে ঠাকুরের আসনের পিছনে একটা ঘটিতে সতেরটা মোহর আছে, ঘরে নিয়ে রেখা। এখানে বেশি দেরি না করে তোমরা কলকাতায় চলে যেও। ঠাকুরের জন্যে ভেব না, আমি পূজার ব্যবস্থা করব।’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’
মালতী বলল, ‘আনন্দকে বোলো আমি তার বাবাকে খুঁজতে গেছি। আর তোমার মাস্টারমশায় যদি কোনোদিন ফেরে তাকে বোলো আমি গোঁসাই ঠাকুরের আশ্রমে আছি, দেখা করতে গেলে কুকুর লেলিয়ে দেব।’
মালতী হাঁটতে আরম্ভ করল। বাগানের গেটের কাছে গিয়ে বলল, ‘ঘরে যাও হেরম্বা। আর শোন, আনন্দকে তুমি বিয়ে করবে তো?’
‘করব।’
‘কোরো তাতে দোষ নেই। আনন্দ জন্মাবার আগেই আমাদের বৈরাগী মতে বিয়ে হয়েছিল, হেরম্ব–সাক্ষী আছে। একদিন কেমন খেয়াল হল, দশজন বৈষ্ণব ডেকে অনুষ্ঠানটা করে ফেললাম। আনন্দকে তুমি যদি সমাজে দশজনের মধ্যে তুলে নিতে পার, হেরম্ব-’ অন্ধকারে মালতী ব্যাকুল দৃষ্টিতে হেরম্বের মুখের ভাব দেখবার চেষ্টা করল—‘ভদ্রলোকের সংসর্গ আলাদা।’
হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘তাই, মালতী-বৌদি।’
ঘরে ফিরে গিয়ে হেরম্ব দেখল, আনন্দ বিছানায় উঠে বসে আছে।
হেরম্ব বিসল।
‘তোমার মা মাস্টারমশায়কে খুঁজতে গেছেন, আনন্দ।’
আনন্দ বলল, ‘জানি।’
‘তুমি জেগে ছিলে নাকি?’
‘এ বাড়িতে মানুষ ঘুমোতে পারে? এ তো পাগলা-গারদ।’
আনন্দের কথার সুরে হেরম্ব বিস্মিত হল। সে ভেবেছিল মালতী চলে গেছে শুনলে আনন্দ একটু কাঁদবে। মালতীকে এত রাত্রে এভাবে চলে যেতে দেওয়ার জন্য তাকে সহজে ক্ষমা করবে না। কিন্তু আনন্দের চোখে সে জলের আভাসটুকু দেখতে পেল না। বরং মনে হল কোমল উপাধীনে মাথা রেখে ওর যে দুটি চোখের এখন নিদ্ৰায় নিমীলিত হয়ে থাকার কথা, তাতে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি দেখা দিয়েছে।
‘কোন ভোলাচ্ছ আমাকে? আমি সব জানি। আমিও উঠে গিয়েছিলাম।’
হেরম্ব আনন্দের দিকে তাকাতে পারল না, আনন্দকে একটু মমতা জানাবার সাধও সে চেপে গেল। সে বড় বেমানান হবে। কাল হয়তো সে আনন্দের চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে, আনন্দের চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারবে, আনন্দের বিবৰ্ণ কপোলে দিতে পারবে স্নেহচুম্বন। আজ স্নেহের চেয়ে সহানুভূতির চেয়ে বেখাপ্পা কিছু নেই। যতক্ষণ পারা যায়। এমনি চুপচাপ বসে থেকে, বাকি রাতটুকু আজ তাদের ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। আজ রাত্রি প্রভাত হলে সে আর একটা দিনও এই অভিশপ্ত গৃহের বিষাক্ত আবহাওয়ায় বাস করবে না। আনন্দের হাত ধরে যেখানে খুশি চলে যাবে।
আনন্দ কথা বলল। ’আমি কি ভাবছি জান?’
‘কি ভাবছ আনন্দ?’
‘ভাবছি, আমারও যদি একদিন মা’র মতো দশা হয়!’
হেরম্ব সভয়ে বলল, ‘ওসব ভেব না, আনন্দ।‘
আনন্দ তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। রুদ্ধ উত্তেজনায় তার দুচোখ জ্বলজ্বল করছে, তার পাণ্ডুর কপোলে অকস্মাৎ অতিরিক্ত রক্ত এসে সঙ্গে সঙ্গে বিবৰ্ণ হয়ে যাচ্ছে।
‘মানুষের ভাগ্যে আমার আর বিশ্বাস নেই। তোমার সঙ্গে আমার ক’দিনের পরিচয়, এর মধ্যে আমার শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। দুদিন পরে কি হবে কে জানে।’
‘শান্তি ফিরে আসবে, আনন্দ।’
আনন্দ বিশ্বাস করল না, ‘আসবে কিন্তু টিকবে কি! হয়তো আমিও একদিন তোমার দুচোখের বিষ হয়ে দাঁড়াব। প্রথম দিন তুমি আর আমি কত উঁচুতে উঠে গিয়েছিলাম, স্বর্গের কিনারায়। আজ কোথায় নেমে এসেছি!’
‘আমরা নামি নি, আনন্দ, সবাই মিলে আমাদের টেনে নামিয়েছে। আমরা আবার উঠিব। লোকালয়ের বাইরে আমরা ঘর বাঁধব, কেউ আমাদের বিরক্ত করতে পারবে না।’
আনন্দ বলল, ‘বিরক্ত আমরা নিজেদের নিজেরাই করব। আমরা মানুষ যে!’ আনন্দ কি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছে? স্বপ্ন ক্ষুন্ন হবার অপরাধে মানুষকে কি ঘৃণা করতে আরম্ভ করল? জেনে নিল বৃহত্তর জীবনে মানুষের অধিকার নেই? বিগত-যৌবন প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়ে তাই যদি আনন্দ জেনে থাকে। তবে তার অপরাধ নেই, কিন্তু এই সাংঘাতিক জ্ঞান বহন করে সে দিন কাটাবে কি করে? হেরম্বের বুক হিম হয়ে আসে–কোথায় সেই প্রেম? পূর্ণিমা তিথির এক সন্ধ্যায় সে যা সৃষ্টি করেছিল? আজ রাত্রিটুকুর জন্য সেই অপার্থিব চেতনা যদি সে ফিরে পেত। হয়তো কোনো এক আগামী সন্ধ্যায়। সেই পূর্ণিমার সন্ধ্যাকে সে ফিরে পাবে। আজ সে আনন্দকে সান্ত্বনা দেবে কি দিয়ে?
হেরম্বের মুখের দিকে খানিকক্ষণ ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আনন্দ চোখ বুজল। ’ঘুমোবে?’–হেরম্ব বলল।
আনন্দ বলল, ‘না।’
হেরম্ব বলল, ‘না। যদি ঘুমোও, আনন্দ, তবে আমাকে নাচ দেখাও। তোমার নাচের মধ্যে আমাদের পুনর্জন্ম হোক।’
আনন্দ চোখ মেলে বলল, ‘নাচব?’
চোখের পলকে রক্তের আবির্ভাবে আনন্দের মুখের বিবর্ণিতা ঘুচে গেছে। হেরম্ব তা লক্ষ করল। তার বুকেও ক্ষীণ একটা উৎসাহের সাড়া উঠল।
‘তাই কর, আনন্দ, নাচ। আমরা একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছি, না? আমাদের জড়তা কেটে যাক।’