বলল, ‘একা, আমার ভয় করছে, হেরম্ব।’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কিসের ভয়?’
মালতী বলল, ‘তা জানি নে, হেরম্ব, ভয়ে আমার হৃৎকম্প হচ্ছিল? তোমরা এ ঘরে শোও।’
হেরম্ব অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে?’
মালতী বলল, ‘মানে আবার কি, মানে? বলছি আমার ভয় করছে, একা থাকতে পারব না, আবার মানে কিসের? ঝাটা এনে ঘরটা একটু ঝাঁট দিয়ে বিছানা পাত, আনন্দ।’
হেরম্ব বলল, ‘আনন্দ আপনার কাছে থাক, আমার থাকবার দরকার নেই।’
মালতী বলল, ‘না বাপু না, আনন্দ থাকলে হবে না। ও ছেলেমানুষ, আমার ভয় করবে।’
হেরম্ব আনন্দের মুখের দিকে তাকাল। আনন্দের নির্বিকার মুখ থেকে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। হেরম্ব বলল, ‘তাহলে সবাই অন্য ঘরে যাই চলুন। এ ঘরে শোয়া যাবে না।’
মালতী রেগে বলল, ‘তুমি বড় বাজে বক, হেরম্ব। বাহাদুরি না করে যা বলছি তাই কর দিকি। যা, আনন্দ, ঝাঁটা নিয়ে আয়।’
ঝাঁটা এনে আনন্দ ঘর ঝাঁট দিল। মালতীর নির্দেশমতো মন্দিরের দিকে জানালা ঘেঁষে হেরম্বের বিছানা হল। মা’র অবাধ্য হয়ে মালতীর বিছানা থেকে যতটা পারে দূরে সরিয়ে শুধু একটি মাদুর পেতে আনন্দ নিজের বিছানা করল। মালতীর অনুযোগের জবাবে রুক্ষস্বরে বলল, ‘আমি কারো কাছে শুতে পারি না।’
যে যার শয্যায় আশ্ৰয় গ্ৰহণ করলে মালতী কাল, ‘সজাগ থেকে ঘুমিও, হেরম্ব, ডাকলে যেন সাড়া পাই।’
হেরম্ব বলল, ‘সজাগও থাকব, ডাকলে সাড়াও পাবেন, এরকম ঘুম ঘুমোব কি করে? তার চেয়ে আমি বসে থাকি।’
মালতী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ার্কি দিও না, হেরম্ব। আমার এদিকে মাথার ঠিক নেই, উনি ঠাট্টা জুড়লেন!’
হেরম্ব বিনা চেষ্টাতেই সজাগ হয়ে রইল। দুটি নারীকে এভাবে পাহারা দিয়ে ঘুমানোর চেয়ে জেগে থাকাই সহজ।
ঘর স্তব্ধ হয়ে থাকে। আনন্দ নিজের আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়েছে; লন্ঠনের আলো দেয়ালে তার যে ছায়া ফেলেছে তাকে মানুষের ছায়া বলে চেনা যায় না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘরে কে ঘুমিয়েছে কে জেগে আছে টের পাওয়া অসম্ভব হয়।
মালতী আস্তে আস্তে হেরম্বের সাড়া নেয়। —‘হেরম্ব?’
‘ভয় নেই, জেগেই আছি।’
‘আচ্ছা, বল দিকি একটা কথা। মানুষকে খুঁজে বার করতে হলে কি করা উচিত?’
‘খুঁজতে বার হওয়া উচিত।’
‘যাবে, হেরম্ব? ক’দিন দেখ না একটু খোঁজ-টোজ করে। খরচ যা লাগে আমি দেব।’
হেরম্ব নির্মম হয়ে বলল, ‘মাস্টারমশায় কি ছোট ছেলে যে খুঁজে পেলে ধরে আনা যাবে? আপনি তো চেনেন। তাকে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ তাকে দিয়ে করানো যায়?’
মালতী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে।
’হেরম্ব?’
‘বলুন, শুনছি।’
পারছে না? ক্ষ্যাপা মানুষ ঝোকের মাথায় চলে গিয়ে হয়তো আফসোস করছে। কেউ গিয়ে ডাকলেই আসবে?’
হেরম্ব এবারো নির্মম হয়ে বলল, ‘এমনি যদিও-বা আসেন, খোঁজাখুঁজি করে বিরক্ত করলে একেবারেই আসবেন না।’
মালতীর কণ্ঠে হেরম্ব কান্নার আভাস পেল।
‘তোমার মুখে পোকা পড়ােক, হেরম্ব, পোকা পড়ুক। তুমিই শনি হয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছ। তুমি যেই এলে অমনি একটা লোক গৃহত্যাগী হল। কই আগে তো যায় নি।’
হেরম্ব চুপ করে থাকে। আনন্দ মৃদুস্বরে বলে, ‘যুমোও না, মা।’
মালতী তাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘তুই জেগে আছিস বুঝি? আমাদের পরামর্শ শুনছিস?’
‘তোমার পরামর্শের চোটেই যে ঘুম আসছে না।’
জবাবে স্বাভাবিক কড়া কথার বদলে মালতী হঠাৎ মিনতির সুরে যা বলল শুনে হেরম্বের বিস্ময়ের সীমা রইল না।
‘আনন্দ, আয় না। মা, আমার কাছে এসে একটু শো। আয়।’
হেরম্ব আরো বিস্মিত হল আনন্দের নিষ্ঠুরতায়।
‘রাতদুপুরে পাগলামি না করে ঘুমোও তো।’
হেরম্বের অভিজ্ঞতায় মালতী আজ প্রথম ধমক খেয়ে চুপ করে রইল। এতক্ষণে হেরম্বের মাথার মধ্যে ঝিমুঝিম্ করছে। এ আশ্ৰম অভিশপ্ত; মালতীর যুগব্যাপী অন্ধ অতৃপ্ত ক্ষুধায় এখানকার বাতাসও বিষাক্ত হয়ে আছে। গভীর নিশিতে এখানে মালতীর সঙ্গে একঘরে জেগে থাকলে দুদিনে মানুষ পাগল হয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, ঘুমুলি?’
আনন্দ সাড়া দিল না।
মালতী উঠে বসল।’হেরম্ব?’
‘জেগেই আছি।’
‘আমার বুকে আগুন জ্বলছে, হেরম্বা। আমি এখানে নিশ্বাস নিতে পারছি না। দিম আটকে আসছে।’
‘একটু ধৈৰ্য না ধরলে–’
মালতী বাধা দিয়ে বলল, ‘কিছু বোলো না, হেরম্ব। একবার ওঠ দিকি। শব্দ কোরো না বাপু, মেয়ের ঘুম ভাঙিও না।’
মালতী উঠে দাঁড়াল। আনন্দের কাছে গিয়ে সে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। হেরম্ব উঠে এলে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখ, মুখ ঢেকে ঘুমিয়েছে। ওকে না জাগিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরাতে পার হেরম্ব? একবার মুখখানা দেখি।’
হেরম্ব সন্তৰ্পণে আনন্দের মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে দিল। খানিকক্ষণ একদৃষ্টি আনন্দের মুখ দেখে হাত দিয়ে তার চিবুক ষ্টুয়ে মালতী চুমো খেল। তারপর পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
থামল সে একেবারে বাড়ির বাইরে বাগানে। হেরম্ব তাকে অনুসরণ করল নীরবে।
মালতী আঁচল থেকে চাবি খুলে হেরন্ধের হাতে দিল।
‘আমি চললাম, হেরম্ব।’
হেরম্ব শান্তকণ্ঠে বলল, ‘চলুন, আমিও যাচ্ছি।’
মালতী বলল, ‘তুমিও ক্ষেপলে নাকি? আনন্দ একা রইল, তুমিও যাচ্ছি। আনন্দের চেয়ে আমার জন্যই তোমার মায়া বুঝি উথলে উঠল?’
হেরম্ব বলল, ‘আপনার সম্বন্ধে আমার একটা দায়িত্ব আছে। রাতদুপুরে আপনাকে আমি একা যেতে দিতে পারি না। ’
মালতী বলল, ‘পাগলামি কোরো না, হেরম্ব। প্রথম বয়সে একবার রাতদুপুরে ঘর ছেড়েছিলাম, মা-বাবা ভাই-বোন কেউই ঠেকাতে পারে নি, পোড় খেয়ে খেয়ে এখন তো পেকে গেছি, তুমি আমাকে আটকাবে? শুধু যে নিজের জ্বালায় চলে যাচ্ছি তা ভেব না, হেরম্ব! আমার মতো মা কাছে থাকলে আনন্দ শান্তি পাবে না। আমি কারণ খাই, আমার মাথা খারাপ, আমার স্বভাব বড় মন্দ, হেরম্ব! তোমার মাস্টারমশাই আমাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে।’