হেরম্বের অনুশোচনার সীমা রইল না। তাই আনন্দ যখন বলল, ‘তোমার আজ কি হয়েছে, তুমি কিছুই বুঝতে চাইছ না কেন?’—তখন সে বিহ্বলের মতো আনন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কথা বলতে পারল না।
আনন্দ তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, ‘দেখ তুমি প্রথম যেদিন এলে সেদিন থেকে আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। জেগে ঘুমিয়ে আমি যেন স্বপ্ন দেখতাম। সব সময় একটা আশ্চর্য সুর শুনছি, নানা রকম রঙিন আলো দেখছি, একটা কিসের ঢেউয়ে আস্তে আস্তে দোলা খাচ্ছি–বিস্ফারিত চোখে হেরম্বের দিকে চেয়ে আনন্দ মাথা নাড়ল–‘বলতে পারছি না যে! আমি যে সব ভুলে গেছি!’
তার ভুলে যাওয়ার অপরাধ যেন হেরম্বের এমনি তীব্রস্বরে সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন ভুলে গেলাম? কেন বলতে পারছি না?’
হেরম্ব অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ভোলো নি, আনন্দ। ওসব কথা মুখে বলা যায় না।’
কিন্তু আনন্দ একান্ত অবুঝ–‘কেন বলা যাবে না? না বললে তুমি যে কিছু বুঝবে না। সব কি রকম স্পষ্ট ছিল জােন? আমার এক এক সময় নিশ্বাস ফেলতে ভয় হত, পাছে সব শেষ হয়ে যায়।’
হেরম্ব কথা বলে না। উত্তেজিত আনন্দও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত হয়।
‘আমার আশপাশে কি ঘটত ভালো জ্ঞান ছিল না। কলের মতো নড়াচড়া করতাম। তারপর যেদিন থেকে মনে হল আমাদের ভালবাসা মরে যাচ্ছে সেদিন থেকে কি কষ্ট যে পাচ্ছি! আচ্ছা! শোন, তোমার কি খুব গরম লাগছে?’
‘না, আজ তো গরম নেই!’
আনন্দ উঠে এসে বলল, ‘দেখ, আমি ঘেমে নেয়ে উঠেছি। আমার কি হয়েছে?’
হেরম্ব গভীর বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘শান্ত হয়ে বোসো। তোমার জ্বর হয়েছে।’
ধীরে ধীরে রাত্রি বেড়ে চলে। আশপাশে অসংখ্য ঝিঝি আর ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। আনন্দকে সান্ত্বনা ও শান্তি দেবার দুঃসাধ্য প্রয়াস একবার প্রাণপণে করে দেখবার জন্য হেরম্বের ঝিমানো মন মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু আজ কোথায় সেই উদ্ধত উৎসাহ, অদম্য প্রাণশক্তি! চিন্তা কষ্টকর, জিহ্বা আড়ষ্ট, কথা সীসার মতো ভারি। মুখ খুঁজে সর্বনাশকে বারণ করা ছাড়া আর যেন উপায় নেই। স্বৰ্গ চারিদিকে ভেঙে পড়ুক। মোহে অন্ধ রক্তমাংসের মানুষের অমৃতের পুত্র হবার স্পর্ধা ধুলায় লুটিয়ে যাক।
প্রেম? মানুষের নব ইন্দ্ৰিয়ের নবলব্ধ ধর্ম? সে সৃষ্টি করেছে। এবার যে পারে বাঁচিয়ে রাখুক। তার আর ক্ষমতা নেই।
আনন্দ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলেছিল, ‘তুমিও আমায় ভাসিয়ে দিলে?’
হেরম্ব শ্ৰান্তস্বরে বলেছিল, ‘কাল সব ঠিক হয়ে যাবে, আনন্দ।’
এ স্পষ্ট প্রতারণা। কিন্তু উপায় কি?
আজ রান্না হয় নি। কিন্তু সেজন্য হেরম্বের আহারের কোনো ত্রুটি হল না। ফল, দুধ এবং বাসি মিষ্টির অভাব আশ্রমে কখনো হয় না, ভাতের চেয়ে এ সব আহার্যের মর্যাদাই এখানে বেশি, মালতীর স্থায়ী ব্যবস্থা করা আছে। আনন্দ প্রথমে কিছু খেতে চাইল না। কিন্তু হেরম্ব তার ক্ষুধার সঙ্গে তার মানসিক বিপর্যয়ের একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করায় রাগ করে একরাশ খাবার নিয়ে সে খেতে বসিল।
হেরম্ব বলল, ‘সব খাবে?’
‘খাব।’
‘তোমার সুমতি দেখে খুশি হলাম, আনন্দ!’
সে চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বোজামাত্র আনন্দ সব খাবার নিয়ে বাইরে ফেলে মুখ-হাত ধুয়ে এল। হেরম্বের বালিশের পাশে এলাচ লবঙ্গ ছিল, একটি এলাচ ভেঙে অর্ধেক দানা সে হেরম্বের মুখে পুঁজে দিল। বাকিগুলি নিজের মুখে দিয়ে বলল, ‘আমি শুতে যাই?’
হেরম্ব চোখ মেলে বলল, ‘যাও।’
যেতে চাওয়া এবং যেতে বলা তাদের আজ উচ্চারিত শব্দগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল।
হেরম্ব ভেবেছিল আজ বুঝি তার সহজে ঘুম আসবে। দেহমানের শিথিল অবসন্নতা অল্পক্ষণের মধ্যেই গভীর তন্দ্রীয় ড়ুবে যাবে। কিন্তু কোথায় ঘুম? কোথায় এই সকাতর জাগরণের অবসান? ঘরের কমানো আলোর মতো স্তিমিত চেতনা একভাবে বজায় থেকে যায়, বাড়েও না কমেও না। হেরম্ব উঠে বাইরে গেল। মালতী আজ তার নিজের ঘর ছেড়ে অনাথের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, মালতীর ঘরে শিকল তোলা। আনন্দই বোধহয় সন্ধ্যার সময় এ ঘরে একটি প্রদীপ জুেলে দিয়েছিল, জানালা দিয়ে হেরম্বের চোখ পড়ল। তেল নিঃশেষ হয়ে প্রদীপের বুকে দপূদপ্ত করে সলতে পুড়ছে। নিজের ঘর থেকে লণ্ঠন এনে হেরম্ব চোরের মতো শিকল খুলে মালতীর ঘরে ঢুকল। আলমারিতে ছিল মালতীর কারণের ভাণ্ডার, কিন্তু সবই সে প্রায় আজ অনাথের ঘরে সঙ্গে নিয়ে গেছে। খুঁজে খুঁজে কাশীর একটি কাজকরা ছোট কালেরঙের মাটির পাত্রে হেরম্ব অল্প একটু কারণ পেল। তাই এক নিশ্বাসে পান করে আবার চুপি চুপি ঘরের শিকল তুলে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
কিন্তু মালতীর কারণে নেশা আছে, নিদ্রা নেই। হেরম্বের অবসাদ একটু কমল, ঘুম এল না। বিছানায় বসে জানোলা দিয়ে সে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।
এমন সময় শোনা গেল মাতলীর ডাক। হেরম্ব এবং আনন্দ দুজনের নাম ধরে সে ফাটিয়ে চিৎকার করছে।
দুজনে তারা প্রায় একসঙ্গেই মালতীর ঘরে প্রবেশ করল। অনাথের প্রায় আসবাবশূন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরখানা মালতী এক বেলাতেই নোংরা করে ফেলেছে। সমস্ত মেঝেতে কাদামাখা পায়ের শুকনো ছাপ, এক কোণে অভুক্ত আহাৰ্য, এখানে-ওখানে ফলের খোসা ও আমের আঁটি। একটি মাটির পাত্র ভেঙে কারণের স্রোত নর্দমা পর্যন্ত গিয়েছিল, এখনো সেখানে খানিকটা জমা হয়ে আছে। ঘরে তীব্ৰ গন্ধ।
কিন্তু মালতীকে দেখেই বোঝা গেল বেশি কারণ সে খায় নি। তার দৃষ্টি অনেকটা স্বাভাবিক, কথাও স্পষ্ট।