‘আমার আজ কি হয়েছে জান?’–আনন্দ বলল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘বল, শুনছি।’
‘সকাল থেকে আমার অশুচি মনে হয়েছে। কেবলি ছোট কথা মনে হয়েছে, হীন অশুদ্ধ ভাব মনে এসেছে। রাগে হিংসায় ঘেন্নায় আমি অস্থির হয়ে পড়েছি। ঠিক যেন নরকবাস করেছি। সারাটা দিন। এমন কষ্ট পেয়েছি আমি! যে ছিল অবোধ নিষ্পাপ শিশু, আজ সে আত্মজ পাপে মাথা হেঁট করল, তাই তোমাকে বলছিলাম সন্ধ্যার পর আমার কাছে থেক, কোথাও যেও না। আমি নিচে নেমে গেছি, আমাকে তুমি তুলে নিতে পার?’
প্রথম দিন পূর্ণিমা রাত্রে নাচ শেষ করে আনন্দ যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছিল এখন তার নতমুখে তেমনি একটা যন্ত্রণার আভাস দেখে হেরম্ব ভয় পেল।
‘এসব কি বলছি, আনন্দ?’
‘মুখ দেখে বুঝতে পারছি না এখনো আমার মন নোংরা হয়ে আছে? একটা ভালো কথা ভাবতে পারছি না। আমার মনে এক ফোঁটা শান্তি নেই।’
হেরম্ব নির্বোধের মতো কথা খুঁজে খুঁজে বলল, ‘ঈর্ষায় তো এরকম হয় না, আনন্দ।’
আনন্দ বিরসা কণ্ঠে বলল, ‘কে বলেছে। ঈর্ষা–শুধু ঈর্ষা হলে তো বীচতাম, আমি সবদিক দিয়ে খারাপ হয়ে গেছি। একটু আগে কি ভাবছিলাম জান?’
‘কি ভাবছিলে?’
‘দেখ, বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।’
‘ফাটবে না, বল।’
আনন্দ আঙুল দিয়ে মেঝেতে দাগ কাটতে কাটতে বলল, ‘বলা আমার উচিত নয়। অন্য মেয়ে হয়তো বলত না। তুমি তো জান আমি অন্য মেয়ের সঙ্গে বেশি মিশি নি। বলা অন্যায় হলে রাগ কোরো না, আমায় ক্ষমা কোরো। দেখ, আমি এত ছোট হয়ে গেছি, একটু আগে তোমাকে খারাপ লোক মনে করেছিলাম।’
আনন্দ যে তার ঠিক কি ধরনের মানসিক অপরাধের কথা স্বীকার করছে হেরম্ব বুঝতে পারল না। তার মনে হল আনন্দের কথায় সুপ্রিয়া সংক্রান্ত কোনো ইঙ্গিত আছে। আনন্দ না বুকুক তার ঈর্ষারই হয়তো একটা শোচনীয় রূপ। তবু কথাটা স্পষ্টভাবে না বুঝে সে কিছু বলতে সাহস পেল না। একটু উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন তা ভাবলে?’
‘তা জানি না। আমার মনে হল আমাকে দেখে তোমার লোভ হয়েছিল। তাই আমাকে ভুলিয়েছ, আমার ছেলেমানুষের সুযোগ নিয়ে।’
হেরম্ব আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তোমায় দেখে কার লোভ হবে না, আনন্দ? আমারও হয়েছিল। সেজন্য আমি খারাপ লোক হব কেন?’
‘লোভ হয়েছিল বলে নয়, শুধু লোভ হয়েছিল বলে। আমায় দেখে তোমার শুধু লোভ হয়েছিল, আর কিছু হয় নি?’
‘অর্থাৎ আমার ভালবাসা-টাসা সব মিছে?’
আনন্দ মুখ তুলে তিরস্কার করে বলল, ‘রাগ করবে না বলে রাগ করছ যে?’
‘রাগ করব না, এমন কথা আমি কখনো বলি নি।’
আনন্দের চোখ ছলছল করে এল। সে এবার মাথা নিচু করে বলল, ‘ঝগড়া করবার সুযোগ পেয়ে তুমি ছাড়তে চাইছ না। আমি গোড়াতেই বলি নি আমি ছোটলোক হয়ে গেছি? আমার একটা খারাপ অসুখ হলে কি তুমি এমনি করে ঝগড়া করবে?’
হেরম্বের কথা সত্য সত্যই রুক্ষ হয়ে উঠেছিল। সে গলা নরম করে বলল, ‘ঝগড়া করি নি, আনন্দ। তুমি আমার সম্বন্ধে যা ভেবেছ তাতেও আমি রাগ করি নি। তুমি নিজেকে কি যেন একটা ঠাওরে নিয়েছ, আমার রাগের কারণ তাই। তুমি কি ভাব তুমি মানুষ নও, স্বর্গের দেবী? কখনো খারাপ চিন্তা তোমার মনে আসবে না? মানুষের মনে হীনতা আসে, মানুষ সেজন্য আত্মগ্লানি ভোগ করে, কিন্তু এই তুচ্ছ সাময়িক ব্যাপারে তোমার মতো বিচলিত কেউ হয় না।’
আনন্দ বিবৰ্ণ মুখে বলল, ‘আমার কি ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে যদি জানতে —’
‘জানি। হওয়া কিন্তু উচিত নয়। আজ তুমি একবার আমাকে বললে তোমার ভয় হচ্ছে, আমাদের ভালবাসা বুঝি মরেই গেল।–এখন বলছ আমি তোমাকে লোভ করেছি, ভালবাসি নি। এসব চিত্তচাঞ্চল্য, আনন্দ, বিচলিত হয়ে এ সমস্তকে প্রশ্ৰয় দিতে নেই।’
আনন্দ আবার মুখ তুলেছিল, তার তাকাবার ভঙ্গি দেখে হেরম্বের মন উদ্বেগে ভরে গেল। আনন্দ তাকে চিনছে, আনন্দের দামি দামি ভুল যেন ভেঙে যাচ্ছে একে একে, তার বিস্ময়ের, বেদনার সীমা নেই। হেরম্ব নিজের ভুল বুঝে সভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ কথা তার স্মরণ নেই যে, তার মতো আনন্দ আজ বাইরের পৃথিবীতে বেড়াতে যায় নি, পরম সহিষ্ণুতায় আলো ও অন্ধকারের যে সমন্বয় নিজের মধ্যে করে নিয়ে পৃথিবীর মানুষ ধৈৰ্য ধরে থাকে আনন্দের কাছে সে সহিষ্ণুতার নাম পরাজয়? সুপ্রিয়ার আবির্ভাবের আগে সে নিজে কি মন নিয়ে এখানে দিন কাটাচ্ছিল হেরম্বের সে কথা মনে পড়ে। এখানে আসবার আগে মনের সেই উদাত্ত উৰ্ব্বগ অবস্থা তার কল্পনাতীত ছিল। কি সেই বিপুল একক পিপাসা–প্রশান্ত, নিবিড়, অনির্বচনীয়। এইখানে গৃহকোণে বসে সমগ্র অভিজাত মনোধর্মের বিরাট সমন্বয়ে চেতনার সেই অনাবিল নিরবচ্ছিন্ন পুলক-স্পন্দন, বিশ্বের এক প্রান্তের ভাঙা কুটির থেকে অন্য প্রান্তের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত প্রসারিত হৃদয়ে নিখিল-হৃদয়ের জীবনোৎসব – অনন্ত, উদার উপলব্ধির মেলা! সেই মনে ছোট স্নেহ, ছোট মমতাকে কে খুঁজে পেয়েছে? সে মনের আলো ছিল দিন, অন্ধকার ছিল রাত্রি–অঙ্গনে বিছানো এক টুকরো রোদ আর তরুতলের ক্ষীণ ছায়ার যোগাযোগ আগের মতো মনের আলো-ছায়ার খেলা সাঙ্গ হয়ে যেত না। সুপ্রিয়াকে মনে করতে হলে সেই মন নিয়ে হেরম্বকে শহরের ধূলিভরা পথে পথে বেড়াতে হত। আর আজ সুপ্রিয়ার কাছ থেকে পরিবর্তিত, ছোট মমতায় ছোট সুখদুঃখে উদ্বেলিত মন নিয়ে এসে সে কি বলে এত সহজে আনন্দের মনের বিচার করে রায় দিচ্ছে?