রান্নার ফাঁকে একসময় হেরম্বকে শুনিয়ে আসে, ‘আর কেউ হলে রান্নাঘরে গিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করত।–ওমা, ঘুমে যে চোখ ঢুলছে!’
‘ভারি ঘুম পাচ্ছে সুপ্রিয়া। সারারাত ঘুমোইনি।’
সুপ্রিয়া বলে, ‘তাই বলে, এখন এই সকালবেলা ঘুমোতে পাবেন না। সারাদিন শরীর বিশ্ৰী হয়ে থাকবে। আরেক কাপ চা পাঠাচ্ছি, খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিন, তারপর দুপুরবেলাটা পড়ে পড়ে যত ইচ্ছে ঘুমোবেন!’
দুপুরবেলা হেরম্বের সঙ্গে গল্প করবে, না কয়েকটা বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করতে বসবে এতক্ষণ সুপ্রিয়া তা ঠিক করে উঠতে পারে নি। দুপুরে হেরম্বের ঘুমের প্রয়োজনে এ সমস্যার মীমাংসা হয়ে যাওয়ায় সে নিশ্চিত হয়।
ভাবে, একা ফেলে রেখে কি আর খাবার করা যেত? পেটুক তো সহজ নয়? এ বেশ হল। ঘুমোবার সময়ের মধ্যেই হাত চালিয়ে সব করে ফেলব। তারপর গা ধুয়ে এসে আর কাজ নয়। শুধু গল্প।
গম্ভীর হেরম্বের সঙ্গে সে কি গল্প করবে সে-ই জানে।
হেরাম্বের জন্য আবার চা করতে গিয়ে সে ফিরে আসে।
‘একটু ব্র্যান্ডি খাবেন? শরীরের জড়তা কেটে যাবে।’
সে তামাশা করছে ভেবে হেরম্ব একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, ‘ব্র্যান্ডি! ব্র্যান্ডি তুই পাবি কোথায়?’
‘আছে। উনি খান যে!’
হেরম্ব অবাক হয়ে বলে, ‘অশোক মদ খায়?’
সুপ্রিয়া হাসে।
‘নেশা করবার জন্যে কি আর খায়? শরীর ভালো নয় বলে ওষুধের মতো খায়। আমিও ক’দিন খেয়েছি। খেলে এমন চিনচনে লাগে শরীর যে মনে হয় ওজন অর্ধেক হালকা হয়ে গেছে। একদিন–রাগ করবেন না তো?–একদিন অনেকটা খেয়ে ফেলেছিলাম। নেশায় শেষে অন্ধকার দেখতে লাগলাম!’
‘তোর সব বিষয়েই বাড়াবাড়ি সুপ্রিয়া। নেশায় কেউ অন্ধকার দ্যাখে?’
‘দ্যাখে না? আমার যে-রকম ভয় হয়েছিল, আপনার হলে বুঝতেন।’ চাবির গোছা হাতে নিয়ে সুপ্রিয়া একটা চাবি বেছে ঠিক করে, ‘বলুন, চা খাবেন, না ব্র্যান্ডি খাবেন। আলমারিতে দু। বোতল আছে। কী রঙ! দেখলে লোভ হয়।’
মাতাল হবার জন্য স্বামী মদ খায় না বলে এটা সুপ্রিয়ার কাছে এখনো হাসির ব্যাপার। কিন্তু হেরম্বের মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ তার হাসি ড়ুবে যায়।
সে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘রাগ করলেন?’ হেরম্বের রাত জাগা লাল চোখ এ প্রশ্নে তার দিকে ফিরে আসে না, স্কুলের ছেলের সামনে কড়া মাস্টারের মতো তার গাম্ভীর্য কোথাও একটু টোল খায় না। রূঢ়, নীরস কণ্ঠে সে সংক্ষেপে বলে, ‘না।’
সুপ্রিয়ার কানে কথাটা ধমকের মতো শোনায়। নিজেকে হঠাৎ অসহায়, বিপন্ন মনে হয়।
‘কি হল, বলুন। আপনাকে বলতে হবে। আমি ব্র্যান্ডি খেয়েছি বলে? সত্যি বলছি, একদিন শুধু শখ করে একটুখানি–’
হেরম্ব বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো কথা বলিস নে, সুপ্রিয়া। তোর অনেক বয়স হয়েছে।’ সুপ্রিয়া দু’পা সামনে এগিয়ে যায়। হেরম্বের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো কথা আমি বলি নি। আপনিই আমায় ছেলেমানুষ করে রাখছেন।–এসব চলবে না, তাকান, তাকান, তাকান আমার দিকে। আমার ছ’বছর বিয়ে হয়েছে, আমি কচি খুঁকি নই যে, হঠাৎ কেন এত রেগে গেলেন শুনতে পাব না।’
হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল না। তেমনিভাবে বসে তেমনি কড়া সুরে বলে, ‘শুনে কি হবে? তুই কি বুঝবি? তোর মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু তুই এমন আস্তে আস্তে নিজের সর্বনাশের ব্যবস্থা করছিস কেন? আমি তোকে ভালো উপায় বলে দিচ্ছি। রাত্রে একদিন অশোককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘরের চালে আগুন লাগিয়ে দিস।’
অনেকক্ষণ স্তব্ধ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সুপ্রিয়া কেঁদে ফেলে। রান্নাঘরে চলে গেল। তার মনে হতে লাগল, বিশেষভাবে তাকে আঘাত করবার জন্যই হেরম্ব এতকাল পরে তার বাড়িতে অতিথি হয়েছে। দুদিনের নোটিশ দিয়ে ওর আকস্মিক আবির্ভাবটা গভীর ষড়যন্ত্রের ব্যাপার। পঁাচ বছরে তার মনের অবস্থা কিরকম দাঁড়িয়েছে, আগে তার একটা ধারণা করে নিয়ে তাকে আঘাত দিয়ে অপমান করে তার কল্পনা ও স্বপ্নের অবশিষ্টটুকু মুছে নেবার উদ্দেশ্যেই হেরম্ব তার বাড়িতে পদার্পণ করেছে। তাকে ও শাসন করবে, সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত একটি বাগানে তার মূল বিস্তার করা দরকার বলে তার সব বাহুল্য ডালপালা ছেটে ফেলবে, এমন একটি শাখা রেখে যাবে না, যেখানে সে দুটি অনাবশ্যক ফুল ফোঁটাতে পারে।
ছোট দারগার সঙ্গে হেরম্ব তার বিয়ে দিয়েছিল। আজ একদিনে সে তাকে ছোট দারগারই বৌ তৈরি করে দিয়ে চলে যাবে।
এবার আর কাজে সুপ্রিয়া মন বসাতে পারে না, মাছের ঝোলে আলুর দিমের গোটা গোটা আলু ছেড়ে খুন্তি দিয়ে তরকারির মতো ঘুটে দেয়। নুন দেওয়া হয়েছে কিনা মনে করতে না পেরে খুন্তিটা উঁচু করে ঠাণ্ডা হবার সময় না দিয়েই একফোঁটা তপ্ত ঝোল জিভে ফেলে দেয়। গরমের জুলাটাই সে টের পায়, নুনের স্বাদ পায় না।
ডেকে বলে, ‘ও পাঁড়ে, দ্যাখ তো নিমক দিয়া কি নেই?’ এবং মাছের ঝোল মুখে করা দূরে থাক পাড়ে তার ছোঁয়া পর্যন্ত খায় না। স্মরণ করে তার রাগ হয়।
‘যাও, তুম্ বাহার চলা যাও।’
ভাবে, ‘হয়েছে। আজ আর আমি রোধে খাইয়েছি!’
তার মনের মধ্যে হেরম্বের কথাটা পাক খেয়ে বেড়ায়। শরীর খারাপ বলে অশোক ওষুধের মতো মদ খেলে তার অপরাধটা কোনখানে হয়। সে ভেবে পায় না। আজকের ওষুধ কাল অশোকের নেশীয় দাঁড়িয়ে গেলেও সে ঠেকাবে কি করে? বারণ সে করতে পারে। একবার কেন দশবার বারণ করতে পারে। দরকার হলে পায়ে ধরে কাঁদাকাটা করতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু চাকরির জোরে বিয়ে-করা বৌয়ের কথা শুনছে। কে? সংসারে সকলে যদি তার কথামতোই চলত। তবে আর ভাবনা ছিল কিসের মদে আসক্তি জন্মে যাবার আশঙ্কা অশোক হেসেই উড়িয়ে দেবে। বলবে, ‘ক্ষেপেছ?’ আমার ওটুকু মনের জোর নেই? এ বোতল দুটো শেষ হলে হয়তো আর কিনবার দরকার হবে না।’ বলবে, ‘কতগুলো টাকা! থাকলে পোষ্টাপিসে জমত। সাধ করে কেউ আত দামি পদাৰ্থ কেনে!’