হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলল, ‘আমি তোর বিয়ে দিই নি সুপ্রিয়া, তোর বাবা দিয়েছিলেন। হ্যাঁ রে, বিয়ের সময় তোকে একটা উপহারও বোধহয় আমি দিইনি দিয়েছিলাম?’
সুপ্রিয়া শেষ কথাটা কানে তুলল না। বলল, ‘বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন বৈকি। আমাকে ভজিয়ে ভজিয়ে রাজি করিয়েছিল কে? কার মুখের বড় বড় ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি ভেসে গিয়েছিলাম। কি সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কথা! কত কথার মানে বুঝি নি। তবু শুনে গা শিউরে উঠেছিল! আচ্ছা, সে সব কথা অভিধানে আছে?’
জবাব দিতে হেরম্বকে একটু ভাবতে হল। সুপ্রিয়ার ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই এটা সে টের পেয়েছিল। কিন্তু তার অনেক, দিনের জমানো নালিশ, কলহ না করলেও নালিশগুলি ও জানিয়ে রাখবে। না জানিয়ে ওর উপায় নেই। মনের নেপথ্যে এত অভিযোগ পুষে রাখলে মানসিক সুস্থতা কারো বজায় থাকে না। এখনকার মতো কথাগুলি স্থগিত রাখলেও সুপ্রিয়ার চলবে না। সে কাল চলে যাবে, দু-চার বছরের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় সুপ্রিয়া বিশ্বাস করে না। যা বলার আছে এখুনি সব বলে দিয়ে বাকি দিনটুকু নিশ্চিন্ত মনে অতিথির পরিচর্যা করবার সুযোগটাও সে বুঝি সৃষ্টি করে নিতে চায়। তার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতির সময়টুকুর মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়বার কারণটা সে গোড়াতেই বিনষ্ট করে দিতে চায়।
চোখের জলের মধ্যে সুপ্রিয়ার বক্তব্য শেষ হবে কিনা ভেবে হেরম্ব মনে মনে একটু ভীত হয়ে পড়েছিল।
‘তোর ভালোর জন্য যতটুকু বলার দরকার তার বেশি আমি কিছুই বলি নি, সুপ্রিয়া।’
‘না বললে আমার মন্দ কি হত? স্কুলে পড়ছিলাম, লেখাপড়া শিখে চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটোতাম। আপনি আমাকে তা করতে দেন নি কেন?’
হেরম্ব মাথা নেড়ে বলল, ‘তোর সহ্য হত না, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন হত না? পাঁচ বছর এই বুনো দেশে পড়ে থাকা সহ্য হচ্ছে, পেট ভরাবার জন্য পরের দাসীবৃত্তি করছি, গরু-বাছুরের সেবা করে আর ঘর গুছিয়ে জীবন কাটাচ্ছি। —ঝিমিয়ে পড়েছি। একেবারে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে আমার সহ্য হত না কেন?’
হেরম্ব বলল, ‘দাসীবৃত্তি করছিস নাকি?’
সুপ্রিয়া তার সহিষ্ণুতা অক্ষুন্ন রেখে বলল, ‘ধরতে গেলে, কথাটা তাই দাঁড়ায় বৈকি!’
হেরম্ব আবার মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তা দাঁড়ায় না। দাঁড়ালেও পৃথিবীসুদ্ধ সব মেয়ে হাসিমুখে যে কাজ করছে, তার বিরুদ্ধে তোর নালিশ সাজে না। চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটানো তুই হয়তো খুব মজার ব্যাপার মনে করিস। আসলে কিন্তু তা নয়। আর্থিক পরাধীনতা স্বীকার করবার সাহস যে মেয়ের নেই তাকে কেউ ভালবাসে না। তাছাড়া-’ এইখানে ইজিচেয়ারের দুইদিকের পাটাতনে কনুইয়ের ভর রেখে হেরম্ব সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ল, ‘তাছাড়া, স্বাধীনতা তোর সইত না। কতকগুলি বিশ্ৰী কেলেঙ্কারি করে জীবনটা তুই মাটি করে ফেলতিস।‘
সুপ্রিয়া সংক্ষেপে শুধু বলল, ‘ইস্!’
‘ইস্ নয়। ওই তোর প্রকৃতি। পনের বছর বয়সেই তুই একটু পেকে গিয়েছিলি, সুপ্রিয়া। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে মেয়েরা সারা জীবনের একনিষ্ঠতা অর্জন করে, তোর মধ্যে সেটা পনের বছর বয়সে এসেছিল। তখনই তোর জীবনের দুটো পথ তুই একেবারে স্থির করে ফেলেছিলি! তার একটা হল লেখাপড়া শিখে স্বাধীন হয়ে থাকা, আর একটা–হেরম্বকে একটু থামতে হল, ‘—অন্যটা এক অসম্ভব কল্পনা।’
সুপ্রিয়া আবার পলকহীন চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘অসম্ভব কেন?’
হেরম্ব চেয়ারে কত হয়ে এলিয়ে পড়ল।
‘যা তুই, রান্নাঘর থেকে একবার ঘুরে আয়গে। ভাগ।’
হেরম্বের আদেশে নয়, আতিথ্যের প্রয়োজনেই সুপ্রিয়াকে একসময়ে রান্নাঘরে যেতে হল। মনে তার কঠিন আঘাত লেগেছে। সংসারে থাকতে হলে সংসারের কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হয়, এটা সুপ্রিয়া জানে এবং মানে। বিয়েই যখন তার করতে হল। তখন মোটা মাইনের হাকিম অথবা অধ্যাপক অথবা পয়সাওয়ালা ডাক্তারের বদলে একজন ছোট দারগার সঙ্গে তাকে গেঁথে দেওয়া হল। কেন ভেবে তার কখনো আফসোস হয় নি। বিয়ের ব্যাপারে বাধ্য হয়ে মানুষকে যে সব হিসাব ধরতে হয় সেদিক থেকে ধরলে কোনো ছেলেমেয়েই সংসারে ঠিকে না। এক বড় দারগা যাচাই করতে এসে তাকে পছন্দ করে নি। তার নাকটা যে বেচা সে অপরাধও সেই বড় দারগার নয়। একটি চোখা নাকের জন্য কষ্ট করে বড় দারগা হয়ে তাকে বাতিল করে দেওয়াটা সুপ্রিয়া তার অন্যায় মনে করে না। তবু তার কিশোর বয়সের কল্পনাটি অসম্ভব কেন, সুপ্রিয়া তার কোনো সঙ্গত কারণ আবিষ্কার করতে পারে নি।
তার হতাশ বেদনা আজো তাই ফেনিল হয়ে আছে। চেনা মানুষ, জানা মানুষ, একান্ত আপনার মানুষ। যে নিয়মে অচেনা অজানা ছোট দারগা তার স্বামী হল, ওই মানুষটির বেলা সে নিয়ম খাটবে কেন? ও খাটতে দেবে কেন? একি বিস্ময়কর অকারণ অন্যায় মানুষের! কেন, ভালবাসা বলে সংসারে কিছু নেই নাকি? সংসারের নিয়মে এর হিসাবটা গুঁজবার ফাঁক নেই নাকি?
সুপ্রিয় ভাবে। এত ভাবে যে বছরে তার দু-তিনবার ফিট হয়।
সুপ্রিয়াকে ডালভাত রাঁধতে হয় না, একজন পাড়ে সিপাহী বেগার দেয়। সুপ্রিয়া রাধে মাছ তরিতরকারি, রাধে ছানার ডালনা। গৃহকর্মকে সে সত্য সত্যই এত ভালবেসেছে যে, মাছের ঝোলের আলু কুটতে বসেই তার মনের আঘাত মিলিয়ে আসে। ওবেলা গা থেকে দুটো মুরগি আনবার মতলবীটাও এ সময় সে মনে মনে স্থির করে ফেলে।