সুপ্রিয়ার এ ঘর সাজানো, ছবির মতো সাজানো। বিছানার ধবধবে চাদরে কোথাও একটি কুঞ্চন নেই, বালিশগুলি নিটোল। দেয়ালের গায়ে পেরেকের শেষ গর্তটি চুনের তলে অদৃশ্য হয়েছে। এদিকে টেবিলে সুপ্রিয়া ও তার স্বামীর প্রসাধন সামগ্ৰীগুলির একটি কোনোদিনই হয়তো আর একটির গায়ে ঠেকে যাবে না, সেলাইয়ের কলের ঢাকনিটি চিরদিন এমনি ধূলিহীন হয়েই থাকবে। প্রতিদিন সুপ্রিয়া কতক্ষণ ঘর সাফ করে আর গোছায় হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারছিল না।
সুপ্রিয়ার পাখার বাতাসে স্নিগ্ধ হতে হতেও সে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল।
এক সময় একটু আচমকাই সে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘দোকানের মতো ঘর সাজিয়েছিস কেন?’
‘দোকানের মতো!’
‘দোকানের মতো না হোক, বাড়াবাড়ি আছে একটু। তোর ভালো লাগে?’
‘কি জানি! ভালো লাগে। কিনা জানিস নে কি রকম?’
‘অত বুঝি নে। মুদ্রাদোষের মতো হয়ে গেছে। না করেই-বা কি করি বলুন। সারাদিন একটা কিছু নিয়ে থাকতে হবে তো মানুষের? একটা ছেলে দিয়ে ভগবান আবার কেড়ে নিলেন। বই-টই পড়তে আমার ভালো লাগে না। এই সবই করি। কিন্তু–সুপ্রিয়ার কথা বলার মধুর ভঙ্গি ফিরে এল, ‘আমার কথা কেন? আগে বলুন আপনার মা কেমন আছেন?’
‘মা আশ্বিন মাসে স্বর্গে গেছেন।’
সুপ্রিয়া চমকে বলল, ‘কি সর্বনাশ!’ তার দুচোখ সজল হয়ে উঠল।
হেরম্ব বলল, ‘মরবার আগে মা তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।’
সুপ্রিয়ার পাখা থেমে গিয়েছিল। আবার সেটা নাড়তে আরম্ভ করে বলল, ‘আমাকে বড়। ভালবাসতেন। আপনাকে হেরম্ববাবু বলার জন্য সকলের কাছে গাল খেয়েছি, তিনিই শুধু হেসে বলতেন, পাগলী মেয়ে।’
হেরম্ব বলল, ‘তখন তুই পাগলীই ছিল সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিল, জবাব দিল না।
সুপ্রিয়া ভারি গৃহস্থ মেয়ে।
গোয়ালা আজ কি কারণে এত বেলাতেও আসে নি। সুপ্রিয়া নিজেই দুরন্ত গরুর বাঁট টেনে হেরম্ব্বের চায়ের দুধ বার করল। উঠানের একপাশে দরমার বেড়ায় ঘেরা স্নানের জায়গা। হেরম্ব সেখানে স্নান করছিল। এই সময় বাইরে এসে তার দুধ দোয়া দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুপ্রিয় বলল, ‘বলক তোলা টাটকা দুধ খাবেন একটু? ভারি উপকারী। উনি রোজ খান। দুইব বেশি করে?’
হেরম্ব বলল, ‘বালক তোলা দুধ শিশুতে খায়। অশোক বাড়ি ফিরলে তাকে খাওয়াস। এ কাজটা শিখলি কবে?’
‘এ আবার শিখতে হয় নাএমবি
‘হয়। কারণ, শিখি নি বলে আমি পারব নাম।’
সুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘পারবেন। দুধ দেবার জন্যে ভোর থেকে গরু আমার হামলাচ্ছে, বাটে হাত দিলে দুধ ঝরবে। তবে আপনাকে কাছেই ঘেঁষতে দেবে কিনা সন্দেহ–গুঁতোবে হয়তো।’
‘কাছে গেলে তো! চাউনি দেখে ভালো বোধ হচ্ছে না।’
‘বড় দুরন্ত। দুবেলা দড়ি ছিঁড়বে, ধরতে গেলে শিং নেড়ে তেড়ে আসবে। কত মোটা শেকল দিয়ে বাঁধতে হয়েছে দেখছেন না? আমি খেতে দিই বলে আমায় কিছু বলে না।’
সুপ্রিয়া সস্নেহে তার গরুর গলা চুলকে দিল। বলল, ‘ঘরেই আয়না চিরুনি আছে।’
গরুর সামনে কয়েক আঁটি খড় ফেলে দিয়ে সে রান্নাঘরে গেল। কাল রাত্রে ছানা কেটেছিল, তাই দিয়ে তৈরি করুল সন্দেশ, সন্দেশ ভালো হল না বলে তার যে কি দুঃখ।
হেরম্বকে খেতে দিয়ে বলল, ‘আপনি খাবেন কিনা, তাই আজ শক্রিতা করেছে।’
হেরম্ব সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আহা হোক না, খাব বৈ তো নয়।’
‘খাবার জন্যই তো খাবার, কিন্তু তাই বলে যা তা দেওয়া যায়? মিহি না হলে সে আবার সন্দেশা! কাল রাত্রে, পড়লাম ফিট হয়ে, নইলে রাত্রেই করে রাখতাম। সারা রাত ফেলে রেখে সে ছানায় কি সন্দেশ হয়?’
হেরম্ব খাওয়া বন্ধ করে বলল, ‘তোর না ফিট সেরে গিয়েছিল?’
‘গিয়ে তো ছিল, এ বছর আবার হচ্ছে। কাল নিয়ে দুবার হল। রান্নাঘরে ছানা ডলছি, হঠা মাথার মধ্যে এমনি ঝিমঝিম করে উঠল! তার পর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হতে দেখি পাড়ে আর দাই গায়ে বালতি বালতি জল ঢালছে, রান্নাঘর ভেসে একেবারে পুকুর!’
‘চা আনি।’ হেরম্বকে কথা বলার অবকাশ না দিয়ে সুপ্রিয়া রান্নাঘরে চলে গেল।
চা এনে সে অন্য কথা পাড়ল।
‘রাঁচিতে ক’দিন ছিলেন?’
‘চারদিন।’
‘এখানে কতদিন থাকবেন?’
‘একদিন।‘
সুপ্রিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘রক্ষে পেলেম। গেলেই বাঁচি।’
চায়ে চুমুক দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে চিবুক ঘষে হেরম্ব বলল, ‘আমাকে তুই কদিন রাখতে চাস?’
‘দিন? বছর বলুন!’
এ কথা হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। সুপ্রিয়া আকস্মিকতা পছন্দ করে না। ওর হিসাবে দিন নেই, মাস নেই, বছর দিয়ে ও জীবনকে ভাগ করেছে। ওর প্রকৃতির কল্পনাতীত সহিষ্ণুতা হেরম্বের অজানা নয়।
তবু তাকে বলতে হল, ‘বছর নয়, মাস নয়, সপ্তাহও নয়। একদিন। শুধু আজ।’
সুপ্রিয়া কথাটা বিশ্বাস করতে পারল না।
‘ওবেলাই চলে যাবেন?’
‘না, কাল সকালে।’
অনেকক্ষণ নীরব থেকে সুপ্রিয়া বলল, ‘একদিন থাকবার জন্য এমন করে আপনার আসার দরকার কি ছিল? পাঁচ বছর খোঁজ নেন নি, আরো পাঁচ বছর নয় না নিতেন।‘
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে কাপড়ে মুখ মুছে হেরম্ব বলল, ‘তাতে লাভ কি হত রে?’
সুপ্রিয়া পলকহীন চোখে চেয়ে থেকে বলল, ‘আপনি বাড়িতে এলে বাইরের ঘরে বসিয়ে এক কাপ চা আর একটু সুজি পাঠিয়ে দিতাম। মনে মনে বলতাম, আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি।’
হেরম্ব একটু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এবার দশ বছর পরে আসব। মনে তোর ক্ষোভ রাখব না, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া আস্তে আস্তে বলল, ‘আপনি তা পারেন। ছেলেমানুষ পেয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমায় যখন বিয়ে দিয়েছিলেন, তখনি জেনেছিলাম। আপনার অসাধ্য কর্ম নেই।’