আনন্দ অনুযোগ দিয়ে বলল, ‘ওঁর কাছে তুমি সব প্রকাশ করে দিচ্ছ মা!’
এই অভিযোগে মালতী কিছুমাত্র বিচলিত হল না, বলল, ‘তাতে কি, যা করছি জেনেশুনেই করছি। হেরম্ব লুকোচুরি ভালবাসে না।’
এই ব্যাখ্যা অথবা কৈফিয়ত হেরম্বের মনে লাগল। সে বুঝতে পারল তার মতামতকে অগ্রাহ্য করে বলে নয়, শেষপর্যন্ত তার কাছে কোনো কথাই লুকানো থাকবে না বলেই মালতী কোনো বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় গ্রহণ করছে না। নিজের এবং নিজেদের সঠিক পরিচয় আগেই তাকে জানিয়ে রাখছে।
এর মধ্যে আরো একটা বড় কথা ছিল, হেরম্বকে যা পুলকিত করে দিল। মালতী আশা করে আজই শেষ নয়, সে আসা-যাওয়া বজায় রাখবে। ভূমিকাতে তার সামনে নিজের সব দুর্বলতা ধরে দিয়ে মালতী শুধু এই সম্ভাবনাই রহিত করে দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে তার যেন আবিষ্কার করার কিছুই না থাকে। হেরম্বের মনে হল এ যেন একটা আশ্বাস, একটা কাম্য ভবিষ্যৎ। সে বার বার আসবে এবং তাদের সঙ্গে এতদূর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে যে মালতীর খাপছাড়া জীবনের সমস্ত দীনতা ও অসঙ্গতি সে জেনে ফেলবে, মালতীর এই প্রত্যাশা নানা সম্ভাবনায় হেরম্বের কাছে বিচিত্র ও মনোহর হয়ে উঠল। মালতীর এই মৌলিক আমন্ত্রণে তার হৃদয় ও প্রফুল্ল হয়ে রইল।
‘একথা মিথ্যা নয় মালতী—বৌদি। আমার কাছে কিছুই গোপন করবার দরকার নেই।’
‘গোপন করার কিছু নেই-ও হেরম্ব।’
‘কি থাকবে?’
‘তাই বলছি। কিছুই নেই।’
একটা যেন চুক্তি হয়ে গেল। মালতী স্বীকার করল সে কারণ পান করে, লোক-ঠকানো পয়সায় জীবিকা নির্বাহ করে। হেরম্ব ঘোষণা করুল, তাতে কিছু এসে যায় না।
জীবন মালতীকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। হয়তো সে শিক্ষা হৃদয় সংক্রান্ত নয়। কিন্তু তার তীক্ষ্ম বুদ্ধিতে সন্দেহ করা চলে না।
কিন্তু আনন্দ?
আনন্দের হৃদয় কি প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও মার্জনা পায় নি? ওর জমকালো বাইরের রূপ তো ওর হৃদয়কে ছাপিয়ে নেই? —হেরম্ব এই কথা ভাবে। মালতী যে মেয়েকে কুশিক্ষা দেবে তার এ আশঙ্কা কমে এসেছিল। সে ভেবে দেখেছে, মালতী ও আনন্দের জীবন এক নয়। যে সব কারণ মালতীকে ভেঙেছে, আনন্দের জীবনে তার অস্তিত্ব হয়তো নেই। তাছাড়া ওদিকে আছে অনাথ। মেয়েরা মার চেয়ে পিতাকেই নকল করে বেশি, পিতার শিক্ষাই মেয়েদের জীবনে বেশি কার্যকরী হয়। অনাথের প্রভাব আনন্দের জীবনে তুচ্ছ হতে পারে না। মালতীর সঙ্গে পরিচয় করে মানুষ যে আজকাল খুশি হতে পারে না, অনাথ সমুদ্রতীরে একথা স্বীকার করেছে। অনাথের যদি এই জ্ঞান জন্মে থাকে, মেয়ের সম্বন্ধে সে কি সাবধান হয় নি?
অনাথ ওস্তাদ কারিগর, হৃদয়ের প্রতিভাবান শিল্পী। আনন্দ হয়তো তারই হাতে গড়া মেয়ে। হয়তো মালতীর বিরুদ্ধ-প্রভাবকে অনাথের সাহায্যে জয় করে তার হৃদয়-মনের বিকাশ আরো বিচিত্র, আরো অনুপম হয়েছে। ঘরে বসে হৃদয়ের দলগুলি মেলবার উপায় মানুষের নেই, মনের সামঞ্জস্য ঘরে সঞ্চয় করা যায় না। মন্দের সম্পর্কে না এলে ভালো হওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। জীবনের রুক্ষ কঠোর আঘাত না পেলে মানুষ জীবনে পঙ্গু হয়ে থাকে, তরল পদার্থের মতো তার কোনো নিজস্ব গঠন থাকে না। আনন্দ হয়তো মালতীর ভিতর দিয়ে পৃথিবীর পরিচয় পেয়ে সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। টবের নিস্তেজ অসুস্থ চারাগাছ হয়ে থাকার বদলে মালতীর সাহায্যেই হয়তো সে পৃথিবীর মাটিতে আশ্রয় নেবার সুযোগ পেয়েছে, রোদ বৃষ্টি গায়ে লাগিয়ে আগাছার সঙ্গে লড়াই করে ও মাটির রস আকর্ষণ করে বেড়ে ওঠা তিরুর মতো সতেজ, সজীব জীবন আহরণ করতে পেরেছে।
কিছুক্ষণের জন্য তিনজনেই নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। অনাথের কিছু দরকার আছে কিনা দেখতে গিয়ে আনন্দ সমস্ত মুখ ভালো করে ধুয়ে এসেছে। হেরম্বের দৃষ্টিকে চোখে না দেখেও তার মুখে যে অল্প অল্প রক্তের ঝাজ ও রং সঞ্চারিত হচ্ছিল বোধহয় সেইজন্যই। তবে আনন্দের সম্বন্ধে কোনো বিষয়ে নিঃসন্দেহ হবার সাহস হেরম্বের ছিল না। তার যতটুকু বোধগম্য হয় আনন্দের প্রত্যেকটি কথা ও কাজের যেন তারও অতিরিক্ত অনেক অর্থ আছে।
আনন্দ বলল, ‘আজ আরতি হবে না মা?’
‘হবে।’
‘এখনো যে মন্দিরের দরজাই খুললে না?’
‘তোর বুঝি খিদে পেয়েছে? প্ৰসাদের অপেক্ষায় বসে না থেকে কিছু খেয়ে তো তুই নিতে পারিস আনন্দ?’
‘খিদে পায় নি মা। খিদে পেলেও আজ খাচ্ছে কে?’
মালতী তার মুখের দিকে তাকাল।
‘কেন, খাবি না কেন? নাচবি বুঝি আজ?’
আনন্দ মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। এখন নয়। চাঁদ উঠুক, তারপর।’
‘আজ আবার তোর নাচবার সাধ জাগল! তোকে নাচ শিখিয়ে ভালো করি নি আনন্দ। রোজ রোজ না খেয়ে–’
আনন্দ নিরতিশয় আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘অনেক রাত্রে আজ চন্দ্ৰকলা নাচটা নাচব মা।’
‘তারপর রাত্রে না খেয়ে ঘুমোবি তো?’
‘ঘুমোলাম-বা! একরাত না খেলে কি হয়? আজ পূর্ণিমা তা জান?’
মালতী বলল, ‘আজ পূর্ণিমা নাকি? তাই কোমরটা টনটন করছে, গা ভারি ঠেকছে।’
হেরম্ব কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি নাচতে পার নাকি আনন্দ?’
মালতী বলল, ‘পারবে না? আর কিছু শিখেছে নাকি মেয়ে আমার। গুণের মধ্যে ওই এক গুণ–নাচতে শিখেছেন। দুটি লোকের রান্না করতে দাও —মেয়ে চোখে অন্ধকার দেখবেন!’
আনন্দ হেসে বলল, ‘মিথ্যে আমার নিন্দ কোরো না মা! বাবাকে দুবেলা রোধে দেয় কে?’
‘যে রান্নাই রোধে দিস, ও তোর বাপ ছাড়া আর কেউ মুখেও করবে না।’