আনন্দ আর একবারও হেরম্বের দিকে তাকায় নি। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে তাকে না দেখে হেরম্বের উপায় ছিল না। ওর সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা তার মনে এসেছে যে, মালতীর পরিবর্তন যদি বেশি। দিনের হয় আনন্দের চরিত্রে হয়তো ছাপা পড়েছে। আনন্দের কথা শুনে, হাসি দেখে, মালতীর দেহ দিয়ে নিজেকে অর্ধেক আড়াল করে ওর বসবার ভঙ্গি দেখে মনে হয় বটে যে, সত্যবাবুর মেয়ের মধ্যে যেটুকু অপূর্ব ছিল, যতখানি গুণ ছিল, শুধু সেইটুকুই সে নকল করেছে; মালতীর নিজের অর্জিত অমার্জিত রুক্ষতা তাকে স্পর্শ করে নি। কিন্তু সেইসঙ্গে এই কথাটাও ভোলা যায় না যে, যে আবহাওয়া মালতীকে এমন করেছে আনন্দকে তা একেবারে রেহাই দিয়েছে।
মালতীর উপর হেরম্বের রাগ হতে থাকে। এমন মেয়ে পেয়েও তার মা হয়ে থাকতে না পারার অপরাধের মার্জনা নেই। মালতী আর যাই করে থাক হেরম্ব বিনা বিচারে তাকে ক্ষমা করতে রাজি আছে, মদ খেয়ে ইতিমধ্যে সে যদি নরহত্যাও করে থাকে। সে চোখ-কান বুজে তাও সমর্থন করবে। কিন্তু মা হয়ে আনন্দকে সে যদি মাটি করে দিয়ে থাকে, হেরম্ব কোনোদিন তাকে মার্জনা করবে না।
খানিক পরে অনাথ বেরিয়ে এল। স্নান সমাপ্ত করে এসেছে।
‘আমার আসন কোথায় রেখেছি মালতী?’
মালতী বলল, ‘জানি না। হ্যাঁগা, স্নান যদি করলে আরতিটা আজ তুমিই করে ফেল না? বড় আলসেমি লাগছে আমার।’
অনাথ বলল, ‘আমি এখুনি আসনে বসব। আরতির জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না।’
‘একজনকে বাড়িতে ডেকে এনে এমন নিশ্চিন্ত মনে বলতে পারলে আসনে বসব? কে তোমার অতিথিকে আদর করবে শুনি? স্বার্থপর আর কাকে বলে! সন্ধ্যা হতেই-বা। আর দেরি কত, এ্যাঁ?’
অনাথ তার কথা কানে তুলল না। এবার আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার আসন কে সরিয়েছে আনন্দ?’
‘আমি তো জানিনে বাবা?’
অনাথ শান্তভাবেই মালতীকে বলল, ‘আসনটা কোথায় লুকিয়েছ, বার করে দাও মালতী। আসন কখনো সরাতে নেই এটা তোমার মনে রাখা উচিত ছিল।‘
মালতী বলল, ‘তুমি অমন কর কেন বল তো? বোস না। এখানে—একটু গল্পগুজব কর! এতকাল পরে হেরম্ব এসেছে, দুদণ্ড বসে কথা না কইলে অপমান করা হবে না?’
হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলতে গেল, ‘আমি —’
কিন্তু মালতী তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমাদের ঘরোয়া কথায় তুমি কথা কয়ো না হেরম্ব।’ হেরম্ব আহত ও আশ্চর্য হয়ে চুপ করে গেল। অনাথ তার বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, ‘আমি অপমান করব কল্পনা করে তুমি নিজেই যে অপমান করে বসলে মালতী! কিছু মনে কোরো না হেরম্ব। ওর কথাবার্তা আজকাল এরকমই দাঁড়িয়েছে।‘
হেরম্ব বলল, মনে করার কি আছে!’
মালতীর মুখ দেখে হেরম্বের মনে হল তাকে সমালোচনা করে এভাবে অতিথিকে মান না। দিলেই অনাথ ভালো করত।
অনাথ বলল, ‘আমার চাদরটা কোথায় রে আনন্দ?’
‘আলিনায় আছে–মার ঘরে! এনে দেব?’
‘থাক। আমিই নিচ্ছি গিয়ে। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ হল না বলে অনাদর মনে করে নিও না হেরম্বা। আমার মনটা আজ একটু বিচলিত হয়ে পড়েছে। আসনে না বসলে স্বস্তি পাব না।?’
হেরম্ব বলল, ‘তা হোক মাস্টারমশায়! আর একদিন কথাবার্তা হবে।‘
মালতী মুখ গোঁজ করে বসেছিল। এইবার সে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাদর দিয়ে হবে কি?’
অনাথ বলল, ‘পেতে আসন করব। আসনটা লুকিয়ে তুমি ভালোই করেছ মালতী। দশ বছর ধরে ব্যবহার করে আসনটাতে কেমন একটু মায়া বসে গিয়েছে। একটা জড় বস্তুকে মায়া করা থেকে তোমার দয়াতে উদ্ধার পেলাম।’
মালতী নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘যা আনন্দ, আমার বিছানার তলা থেকে আসনটা বার করে দিগে যা।‘
অনাথ বলল, ‘থাক, কোজ নেই। ও আসনে আমি আর বসব না।’
মালতী ক্রোধে আরক্ত মুখ তুলে বলল, ‘তুমি মানুষ নও। জানলে? মানুষ তুমি নও! তুমি ডাকাত! তুমি ছোটলোক!’
‘রেগো না মালতী। রাগতে নেই।’
রাখতে নেই, রাগতে নেই! আমার খাবে পরবে, আমাকেই অপমান করবে—রাগতে নেই!’
‘মাথা গরম করা মহাপাপ মালতী।’ —মৃদুস্বরে এই কথা বলে অনাথ বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
খানিকক্ষণ নিঝুম হয়ে থেকে মালতী হঠাৎ তার শদিত হাসি হেসে বলল, ‘দেখলে হেরম্ব? লোকটা কেমন পাগল দেখলে?’
হেরম্ব অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, ‘আমি কি বলব বলুন?’
আনন্দ বলল, ‘বাইরের লোকের সামনেও ঝগড়া করে ছাড়লে তো মা?’
মালতী বলল, ‘হেরম্ব বাইরের লোক নয়।’
হেরম্ব এ কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘না। আমি বাইরের লোক নই আনন্দ।’
আনন্দ বলল, ‘তা জানি। বাইরের লোকের সঙ্গে মা ঠাট্টা-তামাশা করে না। প্রথম থেকে মা আপনার সঙ্গে যেরকম পরিহাস করছিল, তাতে বাইরের লোক হওয়া দূরে থাক, আপনি ঘরের লোকের চেয়ে বেশি প্রমাণ হয়ে গেছেন।’
মালতী বলল, ‘ঘরের লোকের সঙ্গে আমি ঠাট্টা-তামাশা করি নারে, আনন্দ? তামাশা করার কত লোক ঘরে! একটা কথা কওয়ার লোক আছে আমার?’
আনন্দ হাতের তালু দিয়ে আস্তে আস্তে তাঁর পিঠ ঘষে দিতে দিতে বলল, ‘ঘরে নাই-বা লোক রইল মা, তোমার কাছে বাইরের কত লোক আসে, সমস্ত সকালটা তুমি তাদের সঙ্গে কথা কও।’
পিঠ থেকে মেয়ের হাত সামনে এনে মালতী বলল, ‘তারা হল ভক্ত, লক্ষ্মীছাড়ার দল। ওদের ঠকাতে ঠকাতেই প্ৰাণটা আমার বেরিয়ে গেল না! খাচ্ছিস্ দাচ্ছিাস, মনের সুখে আছিস্, লোককে ঠকিয়ে পয়সা করতে কেমন লাগে তুই তার কি বুঝবি! সারা সকালটা গম্ভীর হয়ে বসে বসে শুধু ভাব, কি করে কার কাছে দুটো পয়সা বেশি আদায় হবে। আমি মেয়েমানুষ, আমার কি ওসব পোষায়! তোর বাবা একটা পয়সা রোজগার করে? একবার ভাবে, দিন গেলে পোড়া পেটে পিণ্ডি কোথা থেকে আসে? তুই ভাবিস?’