সুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে এসে হেরম্বের যা হয় নি, এখন তাই হল। নিজের কাছে নিজের মূল্য তার অসম্ভব বেড়ে গেল। সে জটিল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। সাধারণ সুস্থ মানুষ সে নয়। মন তার সর্বদা অপরাধী, অহরহ তাকে আত্মসমর্থন করে চলতে হয়। জীবনে সে এত বেশি পাক খেয়েছে যে মাথা তার সর্বদাই ঘোরে। আনন্দ, পুলক ও উল্লাস সংগ্ৰহ করা আজ তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু আনন্দ আজ তাকে আর তার দৃষ্টিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে, বিচলিত হয়ে তাকে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত করে দিয়েছে। তার দেহ,মন হঠাৎ হাল্কা হয়ে গিয়েছে। তার মনে ভাষার মতো স্পষ্ট হয়ে এই প্রার্থনা জেগে উঠেছে, আনন্দ যেন চলে যাবার আগে আর একবার তার দিকে এমনিভাবে তাকিয়ে যায়।
‘ডাকলে কেন মা?’ আনন্দ মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল।
‘এঁকে এক গেলাস জল এনে দে।‘
আনন্দ জল আনতে চলে গেলে হেরম্ব যেন অসুস্থ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। অনেকদিন আগে অস্ত্রোপচারের জন্য তাকে একবার ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল। সেই সময়কার অবর্ণনীয় অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে।
মালতী নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রকম দেখলে আমার আনন্দকে?’
‘বেশ, মালতী-বৌদি।’
‘আঠার বছর আগে ওকে কোলে পেয়েছিলাম হেরম্ব। জীবনে আমার দুটি সুদিন এসেছে। প্রথম, তোমার মাস্টারমশায় যেদিন দাদাকে পড়াতে এলেন, অন্দরের জানালায় অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে আমি লোকটাকে দেখলাম, সেদিন। আর যেদিন আনন্দ কোলে এল। প্রসববেদনা জান?’
হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘জানি।‘
‘জান! পাগল নাকি, তুমি কি করে জানবে!’
‘আমি এককালে কবিতা লিখতাম যে মালতী-বৌদি!’
‘কবিতা লেখা আর প্রসববেদনা কি এক? মাথা খারাপ না হলে কেউ এমন কথা বলে! তোমাতে আর ভগবান লক্ষ্মীছাড়াতে তাহলে আর কোনো প্রভেদ থাকত না বাপু। আমরা প্রসব করি ভগবানের কবিতাকে, তার তুলনায় তোমাদের কবিতা ইয়ার্কি ছাড়া আর কি! যাই হোক, আনন্দকে দেখে আমি সেদিন প্রসববেদনা ভুলে গেলাম হেরম্ব।’
‘সব মা-ই তাই যায়, মালতী—বৌদি।‘
‘মালতী রাগ করে বলল, ‘তুমি বড় রূঢ় কথা বল হেরম্ব।’
আনন্দ জল আনলে গেলাস হাতে নিয়ে হেরম্ব বলল, ‘বোসে আনন্দ।‘
আনন্দ অনুমতির জন্য মালতীর মুখের দিকে তাকাল।
মালতী বলল, ‘বোস লো ছুঁড়ি, বোস। এ ঘরের লোক। কেমন ঘরের লোক জানিস? আমার ছেলেবেলার ভালবাসার লোক। ওর যখন বার বছর বয়স আমাকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিল। রোজ সন্দেশ-টন্দেস খাইয়ে কত কষ্টে যে তুলিয়ে রাখতাম, সে কেবল আমিই জানি। হাসিস ক্যানো লো! একি হাসির কথা? বিশ বছর ধরে খুঁজে খুঁজে তোর বোপকে খুন করতে এসেছে, তা জানিস্?’
আনন্দ বলল, ‘কি সব বলছ মা? এর মধ্যেই…’
‘এর মধ্যেই কি লো? বল না, এর মধ্যেই কি বলছিস্!’
‘কিছু না মা। চুপ কর।’ মালতী কিন্তু ছাড়ল না।
‘এর মধ্যেই গিলেছি নাকি আজ, এই তো বলছিলি? না গিলি নি! কারণ হল সাধনে, বসার জন্য, যখন তখন আমি ওসব গিলি না বাপু।’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কি মালতী—বৌদি? মদ?’
‘মদ নয়। কারণ। ধর্মের জন্য একটু একটু খাওয়া, এই আর কি!’
আনন্দ বলল, ‘মদ খাওয়া হল ধর্ম!’
মালতী বলল, ‘নয়? এবার বাবা এলে শুধোস্।’ মালতী হেরম্বের দিকে তাকল, ‘বাবার আদেশে একটু একটু খাই হেরম্ব। প্রথমে হয়েছিলাম। বৈষ্ণব–ভক্তিমোর্গ পোষাল না। এবার তাই জোরালো সাধনা ধরেছি। বাবা বলেন।–’
‘বাবা কে?’
‘আমার গুরুদেব। শ্ৰীমৎ স্বামী মশালবাবা!–নাম শোন নি? দিবারাত্রি মশাল জ্বেলে সাধন করেন।’ মালতী যুক্ত কর কপালে ঠেকাল।
আনন্দ বলল, ‘কারণ খাওয়া যদি ধর্ম মা, আমি সেদিন একটু খেতে চাইলাম বলে মারতে উঠেছিলে কেন? কাল থেকে আমিও পেট ভরে ধর্ম করব মা।’
হেরম্ব ভাবে : আনন্দ একথা বলল কেন? সে কারণ খায় না। আমাকে এ কথা শোনাবার জন্যে?
মালতী বলল, ‘করেই দেখিস!’
‘তুমি কর কেন?’
‘আমার ধর্ম করবার বয়স হয়েছে। তুই একরাত্তি মেয়ে, তোর ধর্ম আলাদা। আমার মতো বয়স হলে তখন তুই এসব ধর্ম করবি, এখন কি? যে বয়সের যা। তুই নাচিস্, আমি নাচি?’
আনন্দ হেসে বলল, ‘নেচো না, নোচে। নাচতে তো বাপু একদিন। এখনো এক একদিন বেশি করে কারণ খেলে যে নাচটাই নাচো-’
‘তোর মতো বেয়াদব মেয়ে সংসারে নেই আনন্দ!’
মালতীর পরিবর্তন হেরম্ব বুঝতে পারছিল না। সে মোটা হয়েছে, তার কণ্ঠ কৰ্কশ, তার কথায় ব্যবহারে কেমন একটা নিলাজ রুক্ষতার ভাব। আনন্দের মধ্যস্থতা না থাকলে মালতীর মধ্যে সত্যবাবুর মেয়ের কোনো চিহ্নই খুঁজে না পেয়ে হেরম্ব হয়তো আজ আরো একটু বুড়ো, আরো একটু বিষাদগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরত। কুড়ি বছরের পুরোনো গৃহত্যাগের ব্যাপারটার উল্লেখ মালতী নিজে থেকেই করেছিল, দ্বিধা করে নি, লজ্জা পায় নি। এটা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে যে দশ বছরের মধ্যে একদিনের লজ্জাতুরা নববধূ যদি সকলের সামনে স্বামীকে বাজারের ফর্দ দিতে পারে, মালতীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা কুড়ি বছর পরে তুচ্ছ হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। কিন্তু তার, পরিচয় পাবার পরেও কারণ না এনে দেবার জন্য অনাথকে সে তো অনুযোগ পর্যন্ত করেছিল! আনন্দের সঙ্গে তর্ক করে মদকে কারণ নাম দিয়ে ধর্মের নামে নিজেকে সমর্থন করতেও তার বাধে নি। মালতী এভাবে বদলে গিয়েছে কেন? তার ছেলেবেলার রূপকথার অনাথ আজো তেমনি আছে, মালতীকে এভাবে বদলে দিল কিসে?