‘তোমায় তো বেশ ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে? সাতাশ-আটাশের বেশি বয়স মনে হয় না। তুমি একদিন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে গো! তখন হেসে না মরে যদি রাজি হয়ে যেতাম! আমার তাহলে আজ দিব্যি একটি কচি সুপুরুষ বর থাকত।’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘মাস্টারমশায় তখন যে রকম সুপুরুষ ছিলেন–’
‘মনে আছে?’ মালতী সংগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘বল তো, সেই মানুষকে এখন দেখলে চেনা যায়? আমার বরং এখনো কিছু কিছু রূপ আছে। দেখে তুমি মুগ্ধ হচ্ছ না?’
‘না। ছেলেবেলা মুগ্ধ করে যে কষ্টটাই দিয়েছেন।–’
‘তাই বলে এখন মুখের ওপর মুগ্ধ হচ্ছে না বলে প্রতিশোধ নেবে? তুমি তো লোক বড় ভয়ানক দেখতে পাই। বিয়ে করেছ?’
‘করেছিলাম। বৌটি স্বর্গে গেছে।’
‘ছেলেমেয়ে?’
‘একটা মেয়ে আছে, দু বছরের। আছে বলছি। এই জন্য যে পনের দিন আগে ছিল দেখে এসেছি। এর মধ্যে মরে গিয়ে থাকলে নেই।’
‘বালাই ষাট, মরবো কেন! এখন তুমি কি করছ?’
‘কলেজে মাস্টারি করি।’
‘বৌয়ের জন্য বিবাগী হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড় নি তো?’
‘না। সারাবছর ছেলেদের শেলি কীটুস পড়িয়ে একটু শ্ৰান্ত হয়ে পড়ি মালতী—বৌদি। গরমের ছুটিতে তাই একবার করে বেড়াতে বেরুনো অভ্যোস করেছি। এবার গিয়েছিলাম রাচি। সেখান থেকে বন্ধুর নেমন্তন্ন রাখতে এসেছি। এখানে।’
‘বন্ধু কে?’
‘শঙ্কর সেন, ডেপুটি।’
‘বেশ লোক। বৌটি ভারি ভক্তিমতী। এই মন্দির সংস্কারের জন্য এক শ টাকা দান করেছে।’
মালতী ভাবতে ভাবতে এই কথা বলছিল, অন্যমনস্কের মতো। হঠাৎ সে একটু অতিরিক্ত। আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এখানে কতদিন থাকবে?’
‘দশ-পনের দিন। ঠিক নেই।’
‘ভালোই হল।’
মালতী হাসল।
‘তোমাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে। তাই বললাম। ছেলেদের তুমি কি পড়াও বললে?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘কবিতা পড়াই। ভালো ভালো ইংরেজ কবির বাছা বাছা খারাপ কবিতা। বেঁচে থেকে সুখ নেই মালতী-বৌদি।’
আকস্মিক দার্শনিক মন্তব্যে মালতী হাসল। গলার শ্লেষ্মা সাফ করে বলল, ‘সুখ? নাই-বা রইল সুখ! সুখ দিয়ে কি হবে? সুখ তো শুটকি মাছ! জিভকে ছোটলোক না করলে স্বাদ মেলে না। সুখ স্থান জুড়ে নেই, প্রেম দিয়ে ভরে নাও, আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করা। সুবিধা কত! মদ নেই যদি, মদের নেশা সুধায় মেটাও। ব্যস, আর কি চাই?’
হেরম্ব মালতীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিন সুধা।’
‘আমি দেব?’ মালতী জোরে হেসে উঠল, ‘আমার কি আর সে বয়স আছে!’
‘তবে একটু জল দিন। তেষ্টা পেয়েছে।’
‘তা বরং দিতে পারি।’ বলে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, আনন্দ! একবার বাইরে শুনে যাও!’
‘আনন্দ কে?’ হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল।
‘আমার অনন্ত আনন্দ! মনে নেই? মধুপুরে দেখেছিলে! চুমু খেয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলে!’
‘ওঃ আপনার সেই মেয়ে। তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।’
‘ভুলে গিয়েছিলে? তুমি অবাক মানুষ হেরম্ব! সে কি আমার ভুলবার মতো মেয়ে?’
হেরম্ব বলল, ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কথা আমার মনে থাকে না মালতী—বৌদি। আপনার মেয়ে তখন খুব ছোটই ছিল নিশ্চয়?’
মালতী স্বীকার করে বলল, ‘নিশ্চয় ছোট ছিল। ছোট না থাকলে চুমু খেয়ে তাকে কাঁদাতে কি করে তুমি! তাছাড়া, তখন ছোট না থাকলে মেয়ে তো আমার এ্যাদিনে বুড়ি হয়ে যেত!’
তার পর এল আনন্দ।
আনন্দকে দেখে হেরম্ব হঠাৎ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ল। আনন্দ অন্সরী নয়, বিদ্যাধরী নয়, তিলোত্তম নয়, মোহিনী নয়। তাকে চোখে দেখেই মুগ্ধ হওয়া যায়, উত্তেজিত হয়ে ওঠার কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু হেরম্বের কথা আলাদা। এই মালতীকে নয়, সত্যবাবুর মেয়ে মালতীকে সে আজো ভুলতে পারে নি! এই স্মৃতির সঙ্গে তার মনে বার বছর বয়সের খানিকটা ছেলেমানুষ, খানিকটা কাঁচা ভাবপ্রবণতা আজো আটকে রয়ে গিয়েছে। আনন্দকে দেখে তার মনে হল সেই মালতীই যেন বিশ্বশিল্পীর কারখানা থেকে সংস্কৃত ও রূপান্তরিত হয়ে, গত বিশ বছর ধরে প্রকৃতির মধ্যে, নারীর মধ্যে, বোবা পশু ও পাখির মধ্যে, ভোরের শিশির আর সন্ধ্যাতরার মধ্যে রূপ, রেখা ও আলোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাকে তৃপ্ত করার যোগ্যতা অর্জন করে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শীতকালের ঝরা শুকনো পাতাকে হঠাৎ এক সময় বসন্তের বাতাস এসে যে ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আনন্দের আবির্ভাবও হেরম্বের জীৰ্ণ পুরাতন মনকে তেমনিভাবে নাড়া দিয়ে দিল।
বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে সে আনন্দকে দেখতে লাগল। তার মনের উপর দিয়ে কুড়ি বছর ধরে যে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে, তাই যেন কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে এসেছে।
এই উচ্ছ্বসিত আবেগ হেরম্বের মনে প্রশ্ৰয় পায়। আবেগ আরো তীব্র হয়ে উঠলেই সে যেন তৃপ্তি পেত। তার বন্দি কল্পনা দীর্ঘকাল পরে হঠাৎ যেন আজ মুক্তি পায়। তার সবগুলি ইন্দ্ৰিয় অসহ্য উত্তেজনায় অসংযত প্ৰাণ সঞ্চয় করে। চারিদিকের তরুলতা তার কাছে অবিলম্বে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেষ অপরান্ত্রের রঙিন সূর্যালোককে তার মনে হয় চারিদিকে ছড়িয়ে-পড়া রঙিন স্পন্দমান জীবন।
বাড়ির দরজা থেকে কাছে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত আনন্দ হেরম্বকে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে। দেখেছিল। সে এসে দাঁড়ানো মাত্র হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল। কৌতূহল অন্তর্হিত হয়ে আনন্দের চোখে তখন ঘনিয়ে এল ভাব ও ভয়। হেরম্ব এটা লক্ষ করেছে। সে জানে এই ভয় ভীরুতার লক্ষণ নয়, মোহের পরিচয়। আনন্দের চোখে যে প্রশ্ন ছিল, হেরম্বের নির্বাক নিষ্ক্রিয় জবাবটা তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।