‘না। সংসারের সাধারণ নিয়মে আপনাদের কখনো বিচার করতে পারি নি। মধুপুরে আপনাদের সঙ্গে যখন দেখা হল, আমি ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। হয়তো ছেলেবেলা থেকেই আপনাকে জানবার বুঝবার জন্য আমার মনে প্রবল আগ্রহ ছিল। এখনো যে নেই সে কথা জোর করে বলতে পারব না। আমার মনে যত লোকের প্রভাব পড়েছে, বিশ বছর অদৃশ্য থেকেও আপনি তাদের মধ্যে প্রধান হয়ে আছেন।’
অনাথ নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভগবান! পৃথিবীতে মানুষ একা বেঁচে থাকতে আসে নি–সকলের এটা যদি সব সময় খেয়াল থাকত? মালতীকে না দেখলে তোমার চলবে না হেরম্ব?’
হেরম্ব ক্ষুন্ন হয়ে বলল, ‘আপত্তি করছেন কেন?’
অনাথ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘দুর্বলতা। মনের দুর্বলতা হেরম্ব, চল।’
শহরের নির্জন উপকণ্ঠে সাদা বাড়িটি পার হয়ে হেরম্বের মনে হল, এইখানে শহর শেষ হয়েছে। অনেকক্ষণ সমুদ্রের অর্থহীন অবিরাম কলরব শুনে হেরম্বের মস্তিষ্ক একটু শ্ৰান্ত হয়ে। পড়েছিল। এখানে সমুদ্রের ডাক মৃদুভাবে শোনা যায়। হেরম্বের নিজেকে হঠাৎ ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল। অনাথ গভীর চিন্তামগ্ন অন্যমনস্ক অবস্থায় পথ চলছে। হেরম্ব তাকে প্রশ্ন করে জবাব পায় নি একটারও। বেলা আর বেশি অবশিষ্ট নেই। পথের দুপাশে খোলা মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে রাখালেরা গরুগুলিকে একত্রে করছে। পথ সোজা এগিয়ে গিয়েছে সামনে।
আরো খানিকদূর গিয়ে হেরম্ব ভাঙা প্রাচীরে ঘেরা বাগানটি দেখতে পেল। সামনে পৌঁছে হঠাৎ সচেতন হয়ে অনাথ বলল, ‘এই বাড়ি।’
কোথায় বাড়ি? বাড়ি হেরম্ব দেখতে পেল না। বাগানের শেষের দিকে গাছপালায় প্রায় আড়াল-করা ছোট একটি মন্দির মাত্র তার চোখে পড়ল। বাগানে গোলাপ গন্ধরাজ ফোটে কিনা বাইরে থেকে অনুমান করার উপায় ছিল না। যে গাছে হয়তো ফুল ফোটে কিন্তু গন্ধ দেয় না, যে গাছের ফল অথবা পাতা মানুষে খায়, তাই দিয়ে বাগানটিকে ঠেসে ভর্তি করা হয়েছে। সমস্ত বাগান জুড়ে গাছের নিবিড় ছায়া আর অস্বাভাবিক স্তব্ধতা।
কাঠের ভগ্নপ্রায় গেটটি খুলে অনাথ বাগানে প্রবেশ করল। তাকে অনুসরণ করে বাগানের মধ্যে প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে হেরম্বের মনে হল এ যেন একটা পরিবর্তন, একটা অকস্মাৎ সংঘটিত বৈচিত্ৰ্য। মানুষের অশান্ত কলরব ভরা পৃথিবীতে, ভাঙা প্রাচীরের আবেষ্টনীর মধ্যে এমন সংক্ষিপ্ত একটি স্থানে এই মৌলিক শান্ত আবহাওয়াটি অক্ষুন্ন থাকা হেরম্বের কাছে বিস্ময়ের মতো প্রতিভাত হল।
বাগানের সরু পথটি ধরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গাছের পর্দা পার হয়ে তারা দাঁড়াল। এখানে খানিকটা স্থান একেবারে ফাঁকা। সামনে সেই পথ থেকে দেখা যায় মন্দির। মন্দিরের দক্ষিণে অল্প তফাতে পুরোনো একটি ইটের বাড়ি। মন্দির আর বাড়ি দুই-ই নোনাধরা।
মন্দিরের দরজা বন্ধ। দরজার সামনে ফাটলধরা চত্বরে গরদের শাড়ি-পরা স্কুলাঙ্গী একটি রমণী বসে ছিল। যৌবন তার যাব যাব করছে। কিন্তু গায়ের রং অসাধারণ উজ্জ্বল। চেহারা জমকালো, গম্ভীর।
‘কাকে আনলে গো? অতিথি নাকি?’
শ্লেষ্মাজড়িত চাপা গলা। হেরম্ব একটু অভিভূত হয়ে পড়ল।
অনাথ বলল, ‘চিনতে পারবে মালতী। কলকাতায় তোমাদের বাড়ির পাশে থাকত। নাম হেরম্ব। মধুপুরেও একবার দেখেছিলো।’
মালতী বলল, ‘চিনেছি। তা ওকে আবার ধরে আনবার কি দরকার ছিল! যাক এনেছ যখন, কি আর হবে? বোস বাছা! আহা, সিঁড়িতেই বোস না, মন্দিরের সিঁড়ি পবিত্র। কাপড় ময়লা হবার ভয় নেই, দুবেলা সিঁড়ি ধোয়া হচ্ছে।…তুমি বুঝি গিয়েছিলে সমুদ্রে? একদিন সমুদ্রে না গেলে নয়। যদি গেলেই, বলে কি যেতে নেই?’
অনাথ বলল, ‘আসন থেকে উঠেই চলে গিয়েছিলাম মালতী। তোমাকে বলে যাওয়ার কথা মনে ছিল না।’
মালতী বলল, ‘তবু ভালো, কথার একটা জবাব পেলাম। শহর হয়ে এলে, আমার জিনিসটা আনলে না যে? কাল থেকে পইপই করে বলছি।‘
অনাথ বলল, ‘তোমাকে তো কবে বলে দিয়েছি ওসব আমি এনে দেব না।’
মালতী উষ্ণ হয়ে বলল, ‘কেন, দেবে না কেন? তোমার কি এল গেল।’
‘গোল্লায় যেতে চাও তুমি নিজে নিজেই যাও। আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত নই।’
‘কেতাৰ্থ করলে! আমাকে গোল্লায় এনেছিল কে বের করে? পরের কাছে অপমান করা হচ্ছে!’
মালতী হঠাৎ হেসে উঠল–‘তুমি না। এনে দিলেও আমার এনে দেবার লোক আছে, তা মনে রেখা।–চললে কোথায় শুনি?’
‘স্নান করব?–সংক্ষেপে এই জবাব দিয়ে অনাথ বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘শহর থেকে কি জিনিস আনবার কথা ছিল?’
‘আমার একটা ওষুধ।’ বলে মালতী গম্ভীর হয়ে গেল। তার গাম্ভীর্য হেরম্বকে বিস্মিত করতে পারল না। সে টের পেয়েছিল মালতীর উচ্চ হাসি এবং মুখভার কোনোটাই সত্য অথবা স্থায়ী নয়। যে কোনো মুহূর্তে একটা অন্তৰ্ধান করে আর একটা দেখা দিতে পারে। এর প্রমাণ দেবার জন্যই যেন মালতীর মুখে হঠাৎ হাসি দেখা গেল, ‘কাণ্ড দেখলে লোকটার? তোমায় ডেকে এনে স্নান করতে চলে গেল। জ্বলিয়ে মারে। জানলে? জ্বলিয়ে মারে!…তুমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছ।’
‘আশ্চৰ্য নয়। বত্রিশ বছর বয়স হয়েছে।’
‘তাই বটে! আমি কি আজকে বাড়ি ছেড়েছি! কত যুগ হয়ে গেল। দাঁড়াও, কত বছর হল যেন! কুড়ি। ষোল বছর বয়সে বেরিয়ে এসেছিলাম, আমার তবে ছত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। আঃ কপাল, বুড়ি হয়ে পড়লাম যে! কাণ্ড দ্যাখ!’
হেরম্বকে আগাগোড়া সে ভালো করে দেখল।