সুপ্রিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিল। হেরম্বের বক্তৃতার ঠিক এইখানে তার ফিট হল। গোলমাল শুনে দুজনে গিয়ে দেখে, সুপ্রিয়া বুকের নিচে দুটি হাত জড়ো করে উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।
অশোক চেঁচিয়ে বলল, ‘ওকে শুনিয়ে এসব কথা কি আমায় না বললেই হত না? রাস্কেল!’
রাতদুপুরে সুপ্রিয়া হেরম্বের ঘরে এল।
‘জেগে আছেন?’
‘জেগেই আছি সুপ্রিয়া।’
‘বিছানায় উঠব না! শরীরটা এত দুর্বল লাগছে, দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে।’
‘শুয়ে থাকলি না কেন, সুপ্রিয়া? কেন উঠে এলি?’
‘সকালে চলে যাবেন, কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে, হেরম্ববাবু।’ হেরম্ব চুপ করে থাকে।
‘মাথা ঘুরে হয়তো আবার আমি ফিট হয়ে পড়ে যাব। সবাই উঠে আসবে। বলুন কিছু, বলুন যাহোক কিছু।’
‘তুই তো চিরদিন লক্ষ্মী মেয়ে ছিলি সুপ্রিয়া। এত অবাধ্য, এত দুরন্ত কবে থেকে হলি?’
সুপ্রিয়াকে অন্ধকারেও দেখা যায়। কারণ, অন্ধকারে সে গাঢ়তর অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমার সত্যি দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।’
হেরম্ব এবারো চুপ করে থাকে।
‘আপনি আমাকে ডাকলেই পারেন। আপনি বললেই বিছানায় উঠে বসতে পারি।’
হেরম্ব তবু চুপ করে থাকে। কথা বলবার আগে সুপ্রিয়া এবার অপেক্ষা করে অনেকক্ষণ।
‘আজ টের পেলাম, বৌ কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল। আপনি মেয়ে মানুষের সর্বনাশ করেন। কিন্তু তাদের ভার ঘাড়ে নেবার সময় হলেই যান এড়িয়ে। কাল আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে বলে বিছানায় উঠে বসতে দিচ্ছেন না। আমি দাঁড়াতে পারছি না, তবু!’
হেরম্ব বলে, ‘শোন সুপ্রিয়া। আজ তোর শরীর ভালো নেই, তাছাড়া নানা কারণে উত্তেজিত হয়ে আছিস। ধরতে গেলে আজ তুই রোগী, অসুস্থ মানুষ। আজ তুই যা চাইবি তাই কি তোকে দেওয়া যায়? তবে আর জুরের সময় রোগীকে কুপথ্য দিলে দোষ কি ছিল? বেশি ঝাল হয়েছিল বলে অশোককে তুই আজ মাছের ঝোল খেতে দিস নি মনে আছে? তুই আজ ঘুমিয়ে থাকবি যা সুপ্রিয়া। ছ’মাসের মধ্যে তোর সঙ্গে আমার দেখা হবে। তখন দু’জনে মিলে পরামর্শ করে যা হয় করব।’
‘আরো ছ’মাস!’
‘ছি’ মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।‘
‘যদি দেখা না হয়? আমি যদি মরে যাই?’
জীবনের দিগন্তে তাকে অস্তমিত রেখে সুপ্রিয়া মরতেও রাজি নয়? হেরম্বের দ্বিধা হয়, সংশয় হয়। জীবনকে কোনোমতেই পরিপূর্ণ করবার উপায় নেই। তবু সুপ্রিয়াকে জীবনের সঙ্গে গেঁথে ফেললে হয়তো চিরদিনের জন্য জীবন এত বেশি অপূর্ণ থাকবে যে, একদিন আফসোস করতে হবে হেরম্বের এই আশঙ্কা কমে আসে। তার মনে হয়, আজ একদিনে সুপ্রিয়া ক্ষণে ক্ষণে নিজের যে নব নব পরিচয় দিয়েছে হয়তো তা বহু সংযম, সাবধানতা ও কার্পণ্যের বাধা ঠেলেই বাইরে এসেছে। হয়তো পাঁচবছর ধরে সুপ্রিয়া যে ঐশ্বৰ্য সংগ্রহ করেছে তা অতুলনীয়, কল্পনাতীত। কিন্তু তবু হেরম্ব সাহস পায় নি। নিজেকে দান করবার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে কি আছে? অত বড় দাতা হবার সাহস হেরম্ব সহসা সংগ্রহ করে উঠতে পারে না।
বলে, ‘মরবি কেন, সুপ্রিয়া? লক্ষ্মী মেয়ের মতো তুই বেঁচে থাকবি।’
সুপ্রিয়া চলে গেলে হেরম্ব শয্যা ত্যাগ করে। দরজা খুলে বাইরে যায়। থানার পাহারাদার বলে—’কিধার জাতা বাবু?’
‘ঘুমানে জাতা। নিদ হোতা নেহি।’
আকাশ মেঘে ঢাকা। ওদিকে বিদ্যুৎ চমকায়। শুকনো ঘাসে ঢাকা মাঠে হেরম্ব আস্তে আস্তে পায়চারি করে। আজ রাত্রে যদি বৃষ্টি হয় কাল হয়তো মাঠের বিবৰ্ণ বিশীর্ণ তৃণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
২. রাতের কবিতা
দ্বিতীয় ভাগ : রাতের কবিতা
প্রেমে বন্ধু পঞ্জরের বাধা,
আলোর আমার মাঝে মাটির আড়াল,
রাত্রি মোর ছায়া পৃথিবীর।
বাম্পে যার আকাশেরে সাধা,
সাহারার বালি যার উষর কপাল,
এ কলঙ্ক সে মৃত্য সাকীর।
শান্ত রাত্রি নীহারিকা লোকে,
বন্দী রাত্রি মোর বুকে উতল অধীর–
অনুদার সঙ্কীর্ণ আকাশ।
মৃত্যু মুক্তি দেয় না যাহাকে
প্রেম তার মহামুক্তি।–নূতন শরীর
মুক্তি নয়, মুক্তির আভাষ।
হেরম্ব বলল, ‘এতকাল পরে এইখানে সমুদ্রের ধারে আপনার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে, এ কথা কল্পনাও করতে পারি না। বছর বার আগে মধুপুরে আপনার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল, মনে আছে?’
অনাথ বলল, ‘আছে।’
‘সেবার দেখা হয়ে না থাকলে আপনাকে হয়তো আজ চিনতেই পারতাম না। সত্যবাবুর বাড়ি মাস্টারি করতে করতে হঠাৎ আপনি যেদিন চলে গেলেন, আমার বয়স বোরর বেশি নয়। তারপর কুড়ি–একুশ বছর কেটে গেছে। আপনার চেহারা ভোলবার মতো নয়, তবু মাঝখানে একবার দেখা হয়ে না থাকলে আপনাকে হয়তো আজ চিনতে না পেরে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম।’
অনাথ একটু নিস্তেজ হাসি হাসল।
‘আমাকে চিনেও চিনতে না পারাই তোমার উচিত ছিল হেরম্ব।’
‘আমার মধ্যে ওসব বাহুল্য নেই মাস্টারমশায়। সত্যবাবুর মেয়ে কেমন আছেন?’
‘ভালোই আছেন।’
হেরম্ব অবিলম্বে আগ্রহ প্রকাশ করে বলল, ‘চলুন দেখা করে আসি।’
অনাথ ইতস্তত করে বলল, ‘দেখা করে খুশি হবে না হেরম্ব।’
‘কেন?’
‘মালতী একটু বদলে গেছে।’–অনাথ পুনরায় তার স্তিমিত হাসি হাসল।
হেরম্ব বলল, ‘তাতে আশ্চর্যের কি আছে? এতকাল কেটে গেছে, উনি একটু বদলাবেন বৈকি! আপনি হয়তো জানেন না, ছেলেবেলা আপনার আর সত্যবাবুর মেয়ের কথা যে কত ভেবেছি তার ঠিক নেই। আপনাদের মনে হত রূপকথার রহস্যময় মানুষ।’
অনাথ বলল, ‘সেটা বিচিত্র নয়। ওসব ব্যাপারে ছোট ছেলেদের মনেই আঘাত লাগে বেশি। তারা খানিকটা শুনতে পায়, খানিকটা বড়রা তাদের কাছ থেকে চেপে রাখে। তার ফলে ছেলেরা কল্পনা আরম্ভ করে দেয়। তাদের জীবনে এর প্রভাব কাজ করে। আচ্ছা, তুমি কখনো ঘৃণা কর নি আমাদের?’