- বইয়ের নামঃ দিবারাত্রির কাব্য
- লেখকের নামঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ অবসর প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. দিনের কবিতা
প্রথম ভাগ : দিনের কবিতা
প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক,
পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন
শুষ্ক জীর্ণ তৃণ একগাছি।
ক্ষতবুক তৃষার প্রতীক
রাতের কাজল—লোভী কাতর নয়ন,
ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি।
স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে সে দাঁড়ায়
আমারে পোড়ায় তবু উত্তপ্ত নিশ্বাস
গৃহাঙ্গনে মরীচিকা আনে।
বক্ষ রিক্ত তার মমতায়
এ জীবনে জীবনের এল না আভাস
বিবর্ণ বিশীর্ণ মরুতৃণে।
সকাল সাতটার সময় রূপাইকুড়ার থানার সামনে হেরম্বের গাড়ি দাঁড়াল।
বিস্না পর্যন্ত মোটরে আসতে তার বিশেষ কষ্ট হয় নি। কিন্তু রাত বারটা থেকে এখন পর্যন্ত গরুর গাড়ির ঝাঁকানিতে সর্বাঙ্গ ব্যথা ধরে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে শরীরটাকে টান করে দাঁড়িয়ে হেরম্ব আরাম বোধ করল। এক টিপ নস্য নিয়ে সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
পুব আর পশ্চিমে কেবল প্রান্তর আর দিগন্ত। মাঝে মাঝে দু-একটি গ্রামের সবুজ চাপড়া বসানো আছে, বৈচিত্ৰ্য শুধু এই! উত্তরে কেবল পাহাড়। একটি-দুটি নয়, ধোয়ার নৈবেদ্যের মতো অজস্র পাহাড় গায়ে গায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে–অতিক্রম করে যাওয়ার সাধ্য চোখের নেই, আকাশের সঙ্গে এমনি নিবিড় মিতালি। দক্ষিণে প্রায় আধমাইল তফাতে একটি গ্রামের ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালা ও কতকগুলি মাটির ঘর চোখে পড়ে। অনুমান হয় যে, ওটিই রূপাইকুড়া গ্রাম। গ্রামটির ঠিক উপরে আকাশে এখন রূপার ছড়াছড়ি। তবে সেগুলি আসল রূপা নয়, মেঘ।
গাড়ি দাঁড়াতে দেখে থানার জমাদার মতিলাল বেরিয়ে এসেছিল। হেরম্বকে সে-ই সসম্মানে অভ্যর্থনা করল।
একটু অর্থহীন নিরীহ হাসি হেসে বলল, ‘আজ্ঞে না, বাবু নেই। বরকাঁপাশীতে কাল একটা খুন হয়েছে, ভোর ভোর ঘোড়ায় চেপে বাবু তার তদারকে গেছেন। ওবেলা ফিরবেন—ঘরে গিয়ে আপনি বসুন, আমি জিনিসপত্র নামিয়ে নিচ্ছি। এ কিষণ! কিষণ! ইধর আও তো।
আপিস ও সিপাহীদের ছোট ব্যারাকটির মধ্যে গভীর লালিত্যহীন থানার বাগান। বাগানের শেষপ্রান্তে দারগাবাবুর কোয়ার্টার। চুনকাম-করা কাঁচা ইটের দেয়াল, তলার দিকটা মেঝে থেকে তিন হাত উঁচু পর্যন্ত আলকাতরা মাখানো। চাল শণের। এ বছর বর্ষা নামার আগেই চালের শণ সমস্ত বদলে ফেলায় সকালবেলার আলোতে বাড়িটিকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে! বাড়ির সামনে চওড়া বারান্দা।
ভিতরে যাবার দরজার পর্দা ফাঁক করে একটি সুন্দর মুখ উঁকি দিচ্ছিল। হেরম্ব বারান্দার সামনে এগিয়ে আসতে খসে-পড়া ঘোমটাটি মাথায় তুলে দেবার প্রয়োজনে মুখখানা এক মুহূর্তের জন্য আড়ালে চলে গেল।
তারপর পর্দা সরিয়ে আস্ত মানুষটাই বেরিয়ে এল বারান্দায়।
আগ্রহ ও উত্তেজনা সংযত রেখে সহজভাবেই বলল, ‘আসুন। রাস্তায় কষ্ট হয় নি?’
‘হয়েছিল। এই মুহূর্তে সব ভুলে গেলাম সুপ্রিয়া।’
‘আমায় দেখেই?’ কোমল হাসিতে সুপ্রিয়ার মুখ ভরে গেল, ‘বিশ্বাস করা একটু শক্ত ঠেকছে। যে রাস্তা আর যে গাড়ি, আসবার সময় আমি শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছিলাম। পাঁচ বছর যার খোঁজখবর নেওয়াও দরকার মনে করেন নি, তাকে দেখে অত কষ্ট কেউ ভুলতে পারে?’
‘আমি পারি। কষ্ট হলে যদি সহজে অবহেলাই করতে না পারব, পাঁচ বছর তবে তার খোঁজখবর নিলাম না কেন?’
‘কত সংক্ষেপে কত বড় কৈফিয়ত! মেনে নিলাম ভাববেন না। কিন্তু! আপনার সঙ্গে আমার ঢের ঝগড়া আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আর কথা নয়। ভেতরে চলুন। জামা খুলে গা উদলা করে দিন, পাখা নেড়ে আমি একটু হাত ব্যথা করি। স্নান করবেন তো? আপনার জন্যে এক টবী জল তুলে রেখেছি। ইদারা থেকে তোলা কিনা, বেশ ঠাণ্ডা জল। স্নান করে আরাম পাবেন!’
সুপ্রিয়ার কথা বলার ভঙ্গিটি মনোরম। সকালবেলাই এখন এক শ চার ডিগ্রি গরমে মানুষ সন্তপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু সুপ্রিয়ার যেন একটি দাৰ্জিলিঙের আবহাওয়ার আবেষ্টনী আছে। এত গরমেও তার কথার মাধুর্যের এককণা বাষ্প হয়ে উড়ে যায় নি, তার কণ্ঠে শ্ৰান্তির আভাস দেখা দেয় নি। তার ইদারার জলের মতোই সেও যেন জুড়িয়ে আছে।
বাইরের ঘরের ভিতর দিয়ে অন্দরের বারান্দা হয়ে হেরম্বকে সে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে হেরম্ব লক্ষ করে দেখল, চারিদিকে একটা অতিরিক্ত ঘষামাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ভাব। ঘর ও রোয়াকে ধোয়া মেঝে সবে শুকিয়ে উঠেছে, সাদাকালো দেয়ালে কোথাও একটু দাগ পর্যন্ত নেই। জলের বালতি, ঘটি-বাটি, বসবার আসন প্রভৃতি টুকিটাকি জিনিসগুলি পর্যন্ত কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে স্বস্থানে অবস্থান করছে। স্থানভ্রষ্ট একটি চামচও বোধহয় এ বাড়ির কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না।
ঘরে ঢুকে সুপ্রিয়া বলল, ‘ওই ইজিচেয়ারটাতে বসে সবচেয়ে আরাম হয়। জামা খুলে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ুন। ছারপোকা নেই, কামড়াবে না।’
হেরম্ব জামা খুলে ইজিচেয়ারটাতে বসল। এলিয়ে পড়ার দরকার বোধ করল না।
‘আমার আরামের আর কি ব্যবস্থা রেখেছিস বল তো?’
সুপ্রিয়া সত্য সত্যই পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করা শুরু করে বলল, ‘আরামের ব্যবস্থার কথা। আর বলবেন না, হেরম্ববাবু। বিশ মাইলের মধ্যে চ’টি পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায় না, এমন বুনো দেশ। যে ক’দিন থাকবেন আপনাকে কষ্ট করেই থাকতে হবে।‘–সে একটু হাসল—’তবে কষ্ট আপনি সহজেই অবহেলা করতে পারেন, এই যা ভরসার কথা। নইলে মুশকিলে পড়তাম।’