শুধু দেখতে গেলে এবং ইনভলভমেন্ট না থাকলে ওরকম হয়। যে জায়গায় যাচ্ছে সেই জায়গার সঙ্গে তোমার তো আত্মীয়তা নেই! থাকলে বোরডম টের পেতে না। আমি যখন গাঁয়ে ফিরে যাব, ঠিক চাষী হয়ে যাবো, গেঁয়ো হয়ে যাবে, সব বিদ্যে ভুলে যাবে।
ইউ আর প্যাশনেটলি ইন লাভ উইথ ইওর ভিলেজ। আচ্ছা, আপনি কি চান শহর থেকে মোটরগাড়ি, বাস সব তুলে দিয়ে রিকশা, সাইকেল, ঘোড়ার গাড়ি আর ট্রাম চালু করতে? হাই ফানি। মোহিনী বলছিল।
কৃষ্ণজীবন ম্লান একটু হাসল। বলল, একদিন হয়তো তাই হবে। আমার মতে কী যায় আসে? আমি যা ভাল বুঝি, বলি। আমাদের চেয়ে তোমরা আরও বেশী দিন পৃথিবীতে থাকবে। তোমাদের সন্ততিরা থাকবে আরও বেশী দিন। পৃথিবীকে আমরা যদি তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে ফেলি তাহলে তাদের জন্য কী থাকবে? আমি তো ভাবী পৃথিবীর চেহারা দেখতে পাই, ঘোড়ার গাড়ি ফিরে এসেছে, সাইকেল চলছে। পালকি, গোরুর গাড়ি, নৌকো…
ইউ আর ফানি।
পাশাপাশি সোলার এনার্জি, ব্যাটারি আর উইন্ডমিল। পৃথিবী বসে থাকবে না। বাঁচবার পথ করে নেবেই। কিন্তু বোকারা কিছু বুঝতে পারছে না।
কারা বলুন তো!
মানুষেরা। ক্ষমতাবানরা। যারা পৃথিবীকে চালাচ্ছে তারা।
অনু মুগ্ধতার সঙ্গে চেয়েছিল। হঠাৎ বলল, ইউ আর নাইস। আই অ্যাডোর ইউ।
কৃষ্ণজীবনের আবার, মনে হল, তার একজন প্রম্পটার দরকার। এই পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সংলাপ, সে বুঝতেই পারে না। কত কী বলে দেয় এরা মুখের ওপর। এরা কি এরকমই নাকি! কিন্তু খারাপ লাগছে না। মোটেই খারাপ লাগছে না তার।
অনু চেয়ারটা আর একটু কাছে টেনে বসল। তারপর বলল, আমি শুনেছি, আপনার কোনও ফ্রেন্ড নেই। সত্যি?
কৃষ্ণজীবন অপ্রত্যাশিত এই প্রশ্নে আবার চকিত হল। তারপর মৃদু হেসে বলল, না। আমার কোনওদিনই তেমন কোনও বন্ধু ছিল না। কেন বলো তো!
আমি আপনার ফ্রেন্ড হতে চাই।
তুমি!
আমি খুব ভাল ফ্রেন্ড হবো। আই অ্যাডোর ইউ। ইউ আর এ নাইস ম্যান। মাঝে মাঝে চলে আসবো, গল্প করব। আবোল তাবোর গল্প কিন্তু! রাগ করবেন না তো! ফ্রেন্ডের ওপর রাগ করতে নেই।
মাই গড! তুমি ততা মোহিনীর বন্ধু! তাতে কি? আপনি কি ওল্ড কনসেপশনের লোক?
না, মানে …
কথা হারিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ অনেকদিন পর একটা নির্মল হাসিতে তার মন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। কেন যে ভীষণ ভাল লাগল তার এই অবাস্তব, অসম্ভব প্রস্তাবকে।
কি, রাজী?
কৃষ্ণজীবন সকৌতুকে অনুর দিকে চেয়ে বলে, রাজী। কিন্তু আমার তো অভ্যাস নেই বন্ধুত্বের। কি করতে হয় বলে তো!
আই উইল টিচ ইউ।
শেখাবে?
আপনি তো ভীষণ ভাল আর ছেলেমানুষ, তাই না? আমি আপনাকে সব শিখিয়ে দেব। আজ যাই, নার্সিং হোম-এ যেতে হবে। বাই।
অনু চলে যাওয়ার পর আর কিছুতেই বইয়ে মন দিতে পারল না সে। তার আংশিক বোব মন হঠাৎ যেন অনেক কথা বলে উঠতে চাইছে। মজা লাগছে, হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা পাগল বোধ হয়। কিন্তু এ গুড কম্পানি। তার জীবনে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। কত বয়স হবে মেয়েটার, হার্ডলি পনেরো বা যোলো? পোশাকটা কী ছিল যেন? না শাড়ি নয়। কী যেন? বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছিল তো! বোধহয় সালোয়ার কামিজ! হা, তাই হবে। বেশ ধারালো বুদ্ধির ছাপওয়ালা মুখ।
একটু রাতে নিজস্ব ছোট টেলিস্কোপ আর দোলনকে নিয়ে যখন ছাদে বসে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে তারা দেখার চেষ্টা করছিল কৃষ্ণজীবন তখনও আনন্দের রেশটা রয়েছে।
বাবা, তুমি হাসছে কেন? আমাকে তারা দেখাবে না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আজ বড় মেঘলা, ভাল দেখা যাচ্ছে না।
তুমি হাসছিলে কেন বাবা?
এমনি।
তুমি তো কখনও হাসো না! সবসময়ে গম্ভীর থাকো।
হাসলে কি আমাকে তোমার ভাল লাগে না!
খুব ভাল লাগে।
আজ আমার খুব মজা লাগছে।
কেন বাবা?
এমনিই। কথাটা খাওয়ার টেবিলে রিয়াও তুলল, কী গো, আজ তোমাকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন?
কিরকম?
সেই চেনা মানুষটা তো নয় দেখছি! সেই গোমড়ামুখখা, দ্রুকুটিকুটিল মুখখানা তো দেখছি না। কী হল হঠাৎ?
কৃষ্ণজীবন ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
দোলন নিরীহ গলায় বলে, বাবার আজ খুব মজা লাগছে।
রিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলে, কিসের মজা?
মোহিনী আর সত্রাজিৎ তাদের প্লেট থেকে মুখ তুলে কৃষ্ণজীবনের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তাদের বাবার মজা লাগছে, এরকম অদ্ভুত ঘটনার কথা তারা কখনও শশানেনি।
রিয়া বলল, সবই তো চেপে থাকো। সত্যি বলো ততা, তুমি কোনও অ্যাওয়ার্ড বা রিকগনিশন পাওনি তো!
না, না, বলে কৃষ্ণজীবন নিজেকে ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। বন্ধুত্বও কি অ্যাওয়ার্ড নয়? রিকগনিশন নয়?
রিয়া একটু বিরক্ত মুখে বলল, বিষ্টুপুর থেকে একটা চিঠি এসেছে। পোস্টকার্ড!
একটু চমকে উঠল কৃষ্ণজীবন, কার চিঠি! খারাপ খবর নাকি?
ইউ ডিপেন্ড। তোমার বাবা তোমাকে একবার যেতে লিখেছেন।
কেন?
কি সব গোলমাল হচ্ছে। বাড়ি ভাগাভাগি হবে। তোমার নাকি যাওয়া দরকার।
ওঃ। বলে চুপ করে থাকে কৃষ্ণজীবন।
আমি একটা কথা বলব?
কি কথা?
তুমি কিন্তু নিজের ভাগটা ছেড়ো না। আজকাল কেউ কিছু সহজে ছাড়ে না। তুমিও বোকার মতো ছেড়ে দিও না।
হুঁ। বলে চুপ করে থাকে কৃষ্ণজীবন। চোখে ভেসে ওঠে, কুলগাছ ছেয়ে সোনালতার বিস্তার। কী সবুজ মাঠ। মাটির মদির গন্ধ নাকে ভেসে এল বুঝি!