কৃষ্ণজীবন মেয়েটির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বলে, এমন কিছু দারুণ ব্যাপার নয়। সবই অভ্যাস।
আচ্ছা, আপনি তো হাইলি এডাইট। আপনি কেন চাষ করতেন?
করতাম। আমরা খুব গরিব ছিলাম।
আমি একটু বসতে পারি?
বোসো।
আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না তো?
কৃষ্ণজীবন বিরক্ত হচ্ছে। তবু বলল, কিছু বলবে?
আমি প্রায়ই আসি, জানেন তো?
জানি। তোমার নামটা মনে নেই।
অনু। আপনার সঙ্গে ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আপনি সবসময়ে এত ব্যস্ত থাকেন। আসলে আপনি তো থাকেনই না কলকাতায়।
হ্যাঁ।
আর আপনি ভীষণ গম্ভীর বলে একটু ভয় পাই।
কৃষ্ণজীবন খুব অবাক হয়ে বলে, ভয় পাও? কেন?
মনে হয় আপনি ভীষণ রাগী।
কৃষ্ণজীবন দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, আমার রাগ নেই। রাগতে পারি না। রাগতে পারলে হয়তো ভালই হত। রাগ কি ভাল? আপনি রাগবেন কেন? কখনও রাগবেন না।
কৃষ্ণজীবন ঠিক এ ধরনের কথাবার্তা কখনও শশানে না। মেয়েটি কি খুব সরল? বা মাথায় ছিট আছে? বুঝতে না পেরে সে চুপ করে থাকে।
অনু বলল, আপনার ভয়েসটা দারুণ ভাল। রিয়েল বাস। আর আপনি ভীষণ হ্যান্ডসাম।
মেয়ের বয়সী একটি মেয়ের মুখে একথা শুনে আর একটু বিস্ময় বাড়ল কৃষ্ণজীবনের। যৌবনকালে সে নেহে বটে যে, তার চেহারাখানা ভাল। কিন্তু ভাল চেহারার কোনও উপযোগ বা প্ৰয়োজনীয়তা সে তো অনুভব করে না। তার চিন্তার রাজ্যে চেহারার মূল্যই বা কী?
অনু খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, কিন্তু আপনি একটু শ্যাবি। আজ শেষ করেননি কেন?
কৃষ্ণজীবন নিজের গালে হাত বুলিয়ে নিল নিজের অজান্তেই, বলল, শেভ! করিনি বলছো।
করেননি। সেটাই মনে নেই?
কৃষ্ণজীবন খুব ভাবিত হয়ে বলে, সকালে খুব তাড়া ছিল। কি জানি ভুলেও যেতে পারি। মিনিস্টারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। শেভ তো করার কথা।
ফের খিলখিল করে হাসল অনু। বলল, মোটেই করেননি। আপনার গালে স্টাস রয়েছে।
হতে পারে। তুমি খুব হাসো বুঝি?
অনু একটু গম্ভীর হয়ে বলে, হাসিই তো আমার রোগ। কিন্তু ফর লাস্ট টু উইকস হাসছি না। এই প্রথম আপনার কাছে এসে হাসলাম। আমার বাবা সিরিয়াসলি ইল। হার্ট অ্যাটাক।
ওঃ! বলে কৃষ্ণজীবন খুব অস্বস্তির সঙ্গে চুপ করে থাকে।
এই বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়ই না। জানেই না এরা কেমন।
আজ বাবা একটু বেটার। পেইন নেই, সেডেটিভ কম দেওয়া হচ্ছে। আজ আমার মনটা খুব ভাল লাগছে।
এসব ক্ষেত্রে কী বলতে হবে তা কৃষ্ণজীবন ভেবে পায় না। একজন প্রম্পটার থাকলে ভাল হত। সে শুধু বলল, বাঃ বেশ!
আচ্ছা, আপনি বাড়িতে বুঝি লুঙ্গি পরেন? আমার বাবা পরে পাজামা আর পাঞ্জাবি। সব সময়ে ফিটফাট।
কৃষ্ণজীবন প্ৰচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছে। এ মেয়েটা কি ফাজিল? ফচকে? অসভ্য? ছিটিয়াল? এভাবে কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে কেউ কথা বলে না। এ বাড়িতে তাকে ভাল করে লক্ষই বা করে কে? কৃষ্ণজীবন তার লুঙ্গিটার দিকে চেয়ে বুঝতে পারল না, কৃতকর্মের জন্য তার অনুশোচনা হওয়া উচিত কিনা! জ্বলোকদের কি বাড়িতে পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই থাকা উচিত? সে পাজামা তো পরেইনি, এমনকি তার গা আদুর।
আপনি কি একসারসাইজ করেন? একসারসাইজ! মানে ব্যায়াম?
হ্যাঁ। আমার বাবা একটুও করে না। ডাক্তার বলেছে, এখন থেকে রেগুলার হাঁটতে হবে। অনেকটা করে। অবশ্য এখনই নয়। টোটাল রিকভারির পর। আপনি কিন্তু খুব মাসকুলার। হি-ম্যান। আচ্ছা, গ্রামের বাড়িতে আপনার কে আছে?
কৃষ্ণজীবন এতক্ষণে কূল খুঁজে পেল। গা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সে আজও কথা খুঁজে পায়। কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, সবাই আছে। মা-বাবা, ভাইরা, ভাইদের ছেলেপুলে। আমাদের বেশ বড় সংসার।
সবাই প্লাউম্যান?
প্লউম্যান? না না, চাষের জমি এখন ভাগচাষীদের হাতে। বেশী নেইও। অভাবে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আমার ভাইরা সামান্য চাকরি বা ব্যবসা করে।
আপনার গ্রাম বেশী ভাল লাগে, না শহর।
কৃষ্ণজীবন স্বরাতুর চোখে মেয়েটির দিকে চেয়ে বলে, গ্রাম। আমি একদিন সেখানেই ফিরে যাবো। চাষ করব। গাছের পর গাছ লাগাব। সবুজে সবুজ করে দেবো চারধার।
আপনি তো পলিউশন এক্সপার্ট। গাঁয়ে কোনও পলিউশন নেই, না?
আছে, আছে। পলিউশন সর্বত্র আছে। যেখানে কল-কারখানা নেই, ডিজেলের ধোঁয়া নেই, কেমিক্যাল ফিউম নেই, সেখানে কী আছে জানো? মানুষকে মানুষের গালাগাল, অশ্রাব্য কথা, করাপশন। এগুলোও পলিউশন। ভিতরকার পলিউশন। কলকাতার বস্তি বা ঝুপড়ি দেখনি?
দেখব না কেন! আমাদের বাড়ির পিছনেই একটা আছে।
ঝগড়া শুনতে পাও?
হ্যাঁ। কী অসভ্য অসভ্য গালাগাল দেয়।
সে কথাই বলছি। মানুষ এখনও এইসব পলিউশন নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেনি বোধ হয়। মাতাল, অশিক্ষিত বাপ দূষিত কথা বলে, গাল দেয়, মারধর করে। ছেলেমেয়েরা সেইসব শিখে নেয়। এইভাবেই এত পলিউটেড হয়ে যায় এরা, যখন আর পৃথিবীর সৌন্দর্য বুঝতে পারে না, জীবনের সৌন্দর্য বুঝতে পারে না। গোটা দুনিয়াকে ঘেন্না করতে থাকে।
ইউ টক নাই। মুগ্ধ চোখে চেয়ে অণু বলে।
কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, গ্রামেও সেরকম পলিউশন আছে।
রুরাল লাইফ আমি কখনও দেখিনি। আমার খুব ইচ্ছে করে।
গাঢ় স্বরে কৃষ্ণজীবন বলে, সব মানুষেরই করে। প্রত্যেক মানুষের রক্তেই একটা ফিরে যাওয়ার টান আছে। কিন্তু যেতে পারে না। শহর বেঁধে রাখে।
আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। কখনও পাহাড়ে, কখনও সমুদ্রের ধারে, কখনও জঙ্গলে, কী যে ভাল লাগে। কিন্তু তিন চারদিন পর ইট বিকাম বোরিং। ভেরি বোরং। রোজ পাহাড় দেখছি তো পাহাড়ই দেখছি। নার্থি চেঞ্জেস।