একজন আমলা বললেন, যথেষ্ট গাছপালা লাগানো হচ্ছে, নতুন নতুন বনসৃজন হচ্ছে, পলিউশন তাতেই কন্ট্রোলে থাকবে।
কৃষ্ণজীবন মূক ও বধিরের মতো বসে রইল। তার কথা আসতে চাইছে না। তার পেপারে ভারতবর্ষের বনসৃজনের নামে যে ধাক্টামো হচ্ছে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। জলদি জাতের গাছ লাগিয়ে দায় সারা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেইসব গাছ তাড়াতাড়ি বাড়তে গিয়ে মাটির রসকষ টেনে ছিবড়ে করে ফেলছে। অন্য দিতে বন দফতরের পরোয়ানায় কাটা হচ্ছে। সেইসব গাছ যা বহুদিন ধরে বাড়ে, বহুদিন বাঁচে এবং মাটিকে ধরে রাখে।
বলে লাভ কি? এরা কি জানে না? এরা কি জানে না আজকাল হিমালয় পর্বতমালায় অবধি বৃষ্টি অনিয়মিত এবং পশু-খাদ্যেরও অভাব? পাহাড়ী মানুষেরা জ্বালানী ও অন্য প্রয়োজনে নেড়া করে ফেলছে বৃক্ষ সংবলিত পাহাড়গুলিকে! এরা কি জানে না, পৃথিবী ছাড়া গোটা সৌরমণ্ডলে আর একটিও গ্রহ নেই, যতে প্রাণের বিন্দুমাত্র লক্ষণ আছে? জীবজন্তু, গাছপালা দূরে থাক, কোনও গ্রহে একটি জীবাণুও নেই? এই মহার্ঘ, অনন্য গ্রহটিকে শুধু অবিমৃশ্যকারিতায় একটি মৃত গ্রহে পরিণত করার অধিকার কার আছে?
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট, ডিজেল ইঞ্জিন, কম্প্রেসর, রাসায়নিক ধোঁয়াশা, ক্ষতিকারক গ্যাস সবকিছুর বিরুদ্ধেই সোচ্চার কৃষ্ণজীবন। শুধু ভারতবর্ষ তো নয়, গোটা দুনিয়ায় প্রগতির নামে এক বিপুল যন্ত্র সভ্যতার বিস্তারের বিরুদ্ধেই তার জেহাদ। পৃথিবীর মায়াময় বাতাবরণ ছিদ্ৰময় হয়ে এল। সকল প্রাণের উৎস মহান সূর্য অবিরল ছুঁড়ে দিচ্ছে তার মারক নানা বল্পম। পৃথিবীর মায়াময় আবরণ তা আটকাতে পারছে না আর। উষ্ণ হচ্ছে তার মরু অঞ্চল। বাড়ছে ক্যানসার, চর্মরোগ। অচিরে মেরু প্রদেশের বরফ গলে মহাপ্লাবনের জলের ঢল নেমে আসবে সমুদ্রে।
এত কথা কি বলা যায়?
মন্ত্রী তার দিকে চেয়ে ছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন, লোকটা কি একটু বেহেড? একটু ডাম্ব?
মন্ত্ৰী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ইউ আর অ্যান এক্সপার্ট। আপনি ভেবে দেখবেন।
দুপুরের ফ্লাইটে ফিরে এসেছে কৃষ্ণজীবন।
আনমনে সে কিছুক্ষণ ডোরবেল বাজাল। বিরক্তিকর এক পাখির ডাকের মতো শব্দ হচ্ছে ভিতরে। কে যে এরকম বিরক্তিকর ডোরবেল পছন্দ করেছিল কে জানে! একবার বোতাম টিপলে অনেকক্ষণ ধরে বেজে যায়। অথচ ডোরবেলের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত জোরালো আওয়াজই যথেষ্ট। খামোকা এই শব্দময় শহরে আরও নতুন নতুন বিচিত্র শব্দের দৃষ্টি করা। কে জানে, এ আমলের লোকেরা বোধ হয় শব্দ ভালবাসে। কেবল শব্দ আর শব্দ। সেইজন্যই কি স্টিরিও, রক মিউজিক, চেঁচিয়ে কথা বলা?
দরজা খুলল না। একটা স্পেয়ার চাবি কৃষ্ণজীবনের কাছে থাকে। সে দরজা খুলে খাঁচায় ঢুকল।
বাড়িতে কেউ নেই। রিয়া তার ছেলেমেয়ে সহ কোথায় গেছে। এ বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টার কাজের একটি মেয়েও আছে। তাকেও হয় সঙ্গে নিয়ে গেছে, নয় ছাড়িয়ে দিয়েছে। রিয়া ঘন ঘন কাজের লোক পাল্টায়।
ফাঁকা বাড়িতেই অধিকতর স্বস্তি বোধ করে কৃষ্ণজীবন। তোক থাকলে সে অস্বস্তি বোধ করে। শুধু দোলন ছাড়া। অন্য সব জায়গা থেকে ধাক্কা খেয়ে প্রত্যাহত হয়েছে তার মন। তারপর জড়ো হয়েছে দোলনের ওপর। দোলনকে সে সবটুকু দিয়ে ভালবাসে। সে ভাবে, আমি দোলনকে একটা সবুজ পৃথিবী দিয়ে যাবো।
কৃষ্ণজীবনের কোনও নেশা নেই। চা অবধি খায় না। সে এক গ্রাস জল খেল। বাড়ির পোশক পরে নিজের ঘরে গিয়ে বইপত্র নিয়ে বসল।
বইতে ড়ুব দিলে কৃষ্ণজীবনের কোনও বাহ্যজ্ঞান থাকে না। সে সম্পূর্ণ সম্মোহিত হয়ে থাকে। ড্ডারবেলটা তবু শুনতে পেল সে। অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। মেকানিক্যাল পাখির ডাক।
কৃষ্ণজীবন গিয়ে দরজা খুলল। মুখটা চেনা, কিন্তু নামটা মনে করতে পারল না সে। তার মগজ অধিকার করে আছে। বই।
তারপর হাসল কৃষ্ণজীবন। বলল, ওরা তো কেউ বাড়ি নেই।
মেয়েটা তার দিকে একটু বিস্ফারিত চোখে চেয়েছিল। বলল, আমি একটু ভিতরে আসব?
কেন আসবে তা বুঝতে পারল না কৃষ্ণজীবন। মেয়েটা তার মেয়ে মোহিনীর বান্ধবী। প্রায়ই আসে। নামটা মনে পড়ল না।
দরজা ছেড়ে কৃষ্ণজীবন বলল, আসতে পারে। কিছু দরকার আছে?
আমাদের বাড়ির ফোনে ডায়ালটোন নেই। আমি আপনাদেরটা একটু ব্যবহার করতে পারি?
বিরক্ত কৃষ্ণজীবনের মনেই পড়ল না, তাদের টেলিফোনটা কোথায় আছে। সে টেলিফোন যন্ত্রটাকে সুনজরে দেখে না। উপকারী যন্ত্র বটে, কিন্তু বড় জ্বালায়। টেলিফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে ভালবাসে তার বউ রিয়া আর মেয়ে মোমাহিনী। কী করে বলে কে জানে।
কৃষ্ণজীবন বলল, করতে পারো। হয়ে গেলে যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে যেও। আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।
কৃষ্ণজীবন তার ঘরে এসে ফের বই খুলে বসল। জগৎ-সংসার ভুলে গেল।
কতক্ষণ কেটেছে কে জানে। হঠাৎ কে যেন ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
এই অন্ধকারে কি করে পড়ছিলেন?
কৃষ্ণজীবন তার ঘোর-লাগা চোখ তুলে তাকাল। সেই মেয়েটি।
কৃষ্ণজীবন কী বলবে ভেবে পেল না। খুব অস্বস্তির সঙ্গে বলল, সন্ধে হয়ে গেছে, না?
হ্যাঁ। আপনার চোখ খুব ভাল, তাই এই অন্ধকারেও পড়ে যাচ্ছিলেন।
আলো জ্বালতাম। একটু বাদেই জ্বালতাম।
আমার ফোন করা হয়ে গেছে। দরজাটা টেনে দিয়ে যাও।
আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
কি কথা?
আপনি কখনও লাঙ্গল চালিয়েছেন?
কেন চালাব না? অনেক চালিয়েছি।
সত্যি? দারুণ ব্যাপার, না!