সুবর্ণের মাসি বলিল, এই তো সেদিন এল, এর মধ্যে এত তাড়া কেন? আরেকটা মাস থেকে যাক।
শ্যামা বলিল, না, বাছা : না, তুমি বোঝ না–যার ছেলের বৌ সে ছাড়া কারো বুঝবার কথা নয়–ঘর আমার আঁধার হয়ে আছে।
একে একে দিন গেল। ঋতু পরিবর্তন হইল জগতে। শীত আসিল, শীতল পরলোকে গেল, শ্যামা ধরিল বিধবার বেশ, তারপর শীতও আর রহিল না। সুবর্ণকে শ্যামা যেন বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া একটি দিনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল, কোথায় গেল ক্ষুদ্র বিদ্বেষ, তুচ্ছ শক্ৰতা! সুবর্ণের জীবন লইয়া শ্যামা যেন বাঁচিয়া রহিল। তারপর এক চৈত্র নিশায় এ বাড়ির যে ঘরে শ্যামা একদিন বিধানকে প্রসব করিয়াছিল সেই ঘরে সুবর্ণ অচৈতন্য হইয়া গেল, ঘরে রহিল কাঠকয়লা পুড়িবার গন্ধ, দেয়ালে রহিল শায়িত মানুষের ছায়া, জানালার অল্প একটু ফাঁক দিয়া আকাশের কয়েকটা তারা দেখা গেল আর শ্যামার কোলে স্পন্দিত হইতে লাগিল জীবন।
১২. পাখি কি কখনও খাঁচায় ফেরে
লিফটবাহিত হয়ে কী মসৃণ এই সাতলায় উঠে আসা। তারপর দোরবেল বাজিয়ে দাও। কয়েদখানার দরজা খুলে যাবে। যখনই সে ফেরে তখনই তার মনে হয়, পাখি কি কখনও খাঁচায় ফেরে? গাঁয়ের বাড়িতে সে যখন কবুতর পুষেছিল, বারান্দায় ওপরে লটকানো কাঠের বাক্সের ঘরে রোজ ফিরে আসত পোষা কবুতরেরা। গৃহী পাখি। মানুষকে পুষল কে? মানুষ নিজেই কি? সে ঘর বানাল, কপাট বানাল, নিজেকে পুরল তার মধ্যে। কিন্তু গৃহের মধ্যে কী আশা করে মানুষ। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা, স্বস্তি, নির্ভরতা, স্নেহ? আবার এই তার নিজস্ব ঘর তাকে পৃথিবী থেকে খানিকটা আলাদা করে দেয় না। মানুষ কি ভাবতে শেখে না, এই ঘর আমার, এই বাড়ি আমার, অন্য ঘর-বাড়িগুলো আমার নয়? অন্য ঘরবাড়ি উড়ুক পুড়ুক, আমারটা থাকলেই হয়। মানুষ এইভাবেই কি ক্ৰমে উদাসিন হয়ে যায় ঘরের বাইরের পৃথিবীর প্রতি। অন্য সকলের প্রতি?
অনেকের সঙ্গেই তার মতের অমিল হচ্ছে আজকাল-মন্ত্ৰী, আমলা, কতিপয় শিল্পপতি। কৃষ্ণজীবন তাদের কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারে না। সে বরাবর নন-কমিউনিকেটিভ। কিন্তু লিখিত প্রতিবেদনে সে তুখোড়। সে জানে, তার যুক্তি অকাট্য। তার মত আজ বা কাল পৃথিবীকে গ্রহণ করতেই হবে। আজ হলেই ভাল হয়। কাল বড় দেরি হয়ে যাবে না কি?
ইদানীং তাকে একগাদা কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তাকে ডাকা হচ্ছে বিভিন্ন কনফারেন্সে। বিশেষজ্ঞরা তার কথা শুনছেন। এখনও মানতে পারছেন না। সেইসব লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে দেশ ও বিদেশের নানা পত্র-পত্রিকায়। লোকে তার কথার সারবত্তা বুঝতে পারছে। মানতে পারছে না।
আজ দিল্লিতে সমবেদনাসম্পন্ন, বন্ধুভাবাপন্ন এক মন্ত্রী একটু ক্ষোতের সঙ্গে বললেন, এটা কী করে হয় কৃষ্ণজীবনবাবু, আপনি ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথকেই বন্ধ করে দিতে চাইছেন! ইন্ডাস্ট্রি কমে গেলে প্রােডাকশন কমে যাবে, সরকারের আয় কমবে, আএমপ্লয়মেন্ট দেখা দেবে।
কৃষ্ণজীবন খুব মৃদুস্বরে বলল, মানুষ অনর্থক কিছু বাহুল্য জিনিস তৈরি করে যাচ্ছে। আমি বিচার করে দেখেছি, অনেক কিছু না হলেও মানুষের চলে যায়।
আপনি অনেকগুলো ইন্ডাস্ট্রিকে ব্ল্যাকলিস্টে ফেলতে চাইছেন। একটা চালু ইন্ডাস্ট্রি কি হুট করে বন্ধ করে দেওয়া যায়? বরং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট রিসাইক্লিং-এর জন্য আপনি যে নানারকম প্ল্যান্টের কথা বলেছেন সেটা ভেবে দেখার মতো। কিন্তু তাতেও অনেক টাকার দরকার। এটা তো নতুন কনসেপশন! কিন্তু, কারখানার ধেয়াকে মাটির তলায় চেম্বারে ঢুকিয়ে তা থেকে বাই প্রােডাক্ট করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
আমিও জানি না কি করা যায়। সায়েন্টিস্টরা ব্যাপারটা ভাবলে এবং হাতে-কলমে চেষ্টা করলে কিছু একটা হতে পারে।
মন্ত্রী মাথা নেড়ে বললেন, আমাদের পক্ষে এসব ব্যাপার বড় বেশী নাগালের বাইরে। এটা গরিব দেশ। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি তেমন গ্রো করেনি, এ তো আপনি জানেন। ভারতবর্ষের কলকারখানার দূষণ পৃথিবীর খুব বেশী ক্ষতি করছে না।
ঘরে কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলাও ছিলেন। তারা বললেন, কোথায় আমরা নতুন ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবছি, আর এদিকে আপনি বলছেন ইন্ডাস্ট্রি কমাতে হবে।
কৃষ্ণজীবন যে অর্থনীতি বোঝে না, তা নয়। পরিবেশ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত। সে এও জানে ইন্ডাস্ট্রি কমলে ভারতের ওপর প্রথম ধাক্কাটা হবে মারাত্মক। তবে তার প্রস্তাব যে এঁরা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনাও করছেন না এবং সে চলে গেলেই যে তার বক্তৃতার কপি বাজে কাগজের ঝুড়িতে চালান হয়ে যাবে, এও সে জানে। সে বুঝতে পারছে এরা তাকে একটু বাজিয়ে দেখছে মাত্র, গুরুত্ব দিচ্ছে না। তবু যে সেমিনারের পর তাকে আলাদা ডেকে মন্ত্রী স্বয়ং কথা বলেছেন, এটাই ঢের। কৃষ্ণজীবন ক্লান্ত বোধ করছিল।
এরা কি তাকে পাগল ভাবে। তার প্রস্তাব কি এতই অবাস্তব? কিংবা খুব হাস্যকর? অনেক জ্ঞাণীগুণী তাকে বলেছেন, দূষণবোধ খুব ভাল কথা, কিন্তু আপনি ইন্ডাস্ট্রি কমাতে বলছেন, সেটা তো ঘড়িকে উল্টোদিকে চালানো!
ঠিক কথা। কৃষ্ণজীবন গোটা দুনিয়াকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাইছে, ভোগ কমাও, ভোগ্যপণ্য সংযত করো, অল্প নিয়ে থাকে, যদি শেষ অবধি বাঁচতে চাও, যদি সন্তানসন্ততির বেঁচে থাকা চাও। মন্ত্রী মানছেন না, আমলারা মানছেন না, অর্থনীতিবিদরা মানতে রাজি নন, তবু দুষণমুক্ত পৃথিবীর নানা দিকে যে শঙ্কিত পরিবেশ-চেতনার উন্মেষ ঘটছে তাতে ক্ৰমে ক্ৰমে কৃষ্ণজীবনের কণ্ঠস্বরটিই কি প্রবল হয়ে উঠবে না একদিন? কিছু লোক কৃষ্ণজীবনের কথা শুনছে, অনুধাবন করছে, সমর্থন করছে। তাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলেই কি মন্ত্রী তাকে নিজের ঘরে আমন্ত্রণ করে আনেননি?