সত্যই কি শ্যামার আবার সেইরকম হইতেছে, বনগাঁয়ে যেমন হইয়াছিল, যেজন্য পড়া ছাড়িয়া চাকরি লইতে হইয়াছিল বিধানকে? শ্যামার চোখের দিকে তাকাও, বাহিরে দুরন্ত রোদের যেমন তেজ তেমনি জ্বালা শ্যামার চোখে। এ বুঝি জীবনব্যাপী দুঃখের অভিশাপ। আজীবন শান্ত আবেষ্টনীর মধ্যে সুরক্ষিত আশ্রয়ের আড়ালে বাস করিতে না পারলে এমনি বুঝি হইয়া যায় অসহায়া নারী, আজীবন দুঃখ দুর্দশার পীড়ন সহিয়া শেষে যখন সুখী হওয়ার সময় আসে তখন তুচ্ছ আবহাওয়ার উত্তাপেই গলিয়া যায়। আঁচল গায়ে জড়াইয়া শ্যামা কত শীত কাটাইয়া দিয়াছে, তিনটি উনানের আঁচে বসিয়া পার করিয়া দিয়াছে কত গ্ৰীষ্ম। এবার সে এত কাবু হইয়া গেল!
তারপর একদিন আকাশে ঘনঘটা আসিল। মাটি জুড়াইল, জুড়াইল মানুষ। বিকারের শেষের দিকে ধীরে ধীরে চুপ করিয়া মানুষ যে ভাবে ঘুমাইয়া পড়ে শ্যামাও তেমনিভাবে ক্ৰমে ক্ৰমে শান্ত
ও বিষ হইয়া আসিল।
সকলে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল।
তবু সুবর্ণকে শ্যামা পুরাপুরি সুনজরে দেখতে পারি না। একটা বিদ্বেষের ভাব রহিয়াই গেল। বিধান কত আদরের ছেলে শ্যামার, সাত বছর বন্ধ্যা থাকিয়া, প্রথম সন্তানকে বিসর্জন দিয়া ওকে শ্যামা কোলে পাইয়াছিল–সুবর্ণ তার বৌ! তবুও সুবর্ণকে বুকের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিল না, কি দুৰ্ভাগ্য শ্যামার।
শীতল তেমনি অবস্থায় এখনো বাঁচিয়া আছে, ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী বুঝি ব্যর্থ হইয়া যায়। এতদিনে তার মরিয়া যাওয়ার কথা। মৃত্যু কিন্তু দুটি একটি অঙ্গ গ্রাস করিয়া, সর্বাঙ্গের প্রায় সবটুকু শক্তি শুষিয়া তৃপ্ত হইয়া আছে, হঠাৎ কবে আবার ক্ষুধা জাগিবে এখনো কেহ তাহা বলিতে পারে না।
শ্যামা বলে, হ্যাঁ গা, বড় কি কষ্ট হচ্ছে? কি করবে বল দেখিঃ বৌমা বসবে একটু কাছে? গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে? কোনে কষ্ট তোমার? ও মণি ডাক তো তোর বৌদিকে, ওষুধ মালিশ করে দিয়ে যাক!—কোথায় যে যায়, ফাঁক পেয়েই কি ছেলের সঙ্গে ফসফস গুজাজ করতে চলল
–কি মন্ত্র দিচ্ছে কানে কে জানে!
সুবর্ণ ওষুধ মালিশ করতে বসে।
শ্যামা বলে, দেখ তো মণি ও-বাড়ির ছাদে কে? নকুড়বাবুর বাঁশি বাজানো ভাইটে বুঝি? দে। তো দরজাটা ভেজিয়ে, বৌমা, আরেকটু সামলে সুমলেই না হয় বসতে বাছা, একটু বেশি লজ্জা থাকলে ক্ষেতি নেই কারো।
সুবৰ্ণ জড়োসড়ো হইয়া যায়, রাঙা মুখ নত করে। শ্যামা যখন এমনিভাবে বলে কোনো উপায়ে মিশাইয়া যাওয়া যায় না শূন্যে?
ভালো লাগে না, বলিয়া শ্যামারও ভালো লাগে না! সুবর্ণের স্নান মুখখানা দেখিয়া কত কি সে ভাবে! ভাবে, সে যদি আজ অমনি বৌ হইত এবং আর কেহ যদি অমনি করিয়া তাকে বলিত, কেমন লাগিত তার? বিধানের কানে গেলে কত ব্যথা পাইবে সে। মণি বড় হইতেছে, কথাগুলি তার মনে না-জানি কিভাবে কাজ করে। একি স্বভাব, একি জিহ্বা হইয়াছে তার? কেন সে না বলিয়া থাকিতে পারে না? শ্যামা বাহিরে যায়। বর্ষার মেঘলা দিন। ধানকলের অঙ্গনে আর ধান মেলিয়া দেয় না, অত বড় অঙ্গনটা জনহীন, কুলিরমণী নাই, পায়রার ঝক নাই। খুকিকে শ্যামা বুকের কাছে আরো উঁচুতে তুলিয়া ধরে। বিধানের বৌকে কি কটু কথা শ্যামা বলিয়াছে, কি বিষাদ শ্যামার মনে–দিদিগন্ত চোখের জলে ঝাপসা হইয়া গেল।
আশ্বিনের গোড়ায় হারাধন মেয়েকে লইয়া গেল।
যাওয়ার সময় সুবৰ্ণ অবিকল মা-হারা মেয়ের মতোই ব্যবহার করিয়া গেল। শ্যামা ভালবাসে না, শ্যামা কটু কথা বলে, তবু মনে হইল সুবর্ণ যাইতে চায় না, এখানে থাকিতে পারিলেই খুশি হইত। শ্যামা নির্বিবাদে ভাবিয়া বসিল, এ টান বিধানের জন্য–সে যা ব্যবহার করিয়াছে তার জন্য সুবর্ণের কিসের মাথাব্যথা?
পূজার পরেই আমায় আনাবেন মা।–সুবর্ণ সজল চোখে বলিয়া গেল।
শ্যামা শুধু বলিল, আনব।
বিধানের বৌ! সে বাপের বাড়ি যাইতেছে। বুকে জড়াইয়া একটু তো শ্যামা দিতে পারি? কিন্তু কি করিবে শ্যামা, যাওয়ার জন্য সুবর্ণ তখন সাজগোজ করিয়াছে, বৌয়ের চোখ ঝলসানো মূৰ্তির দিকে শ্যামা চাহিতে পারিতেছিল না, মনে হইতেছিল, যাক, ও চলিয়া যাক, দুদিন চোখ দুটা একটু জুড়াক শ্যামার।
পূজার সময় মন্দা আসিয়া কয়েকদিন রহিল। শীতলকে দেখিতে আসিয়াছে। মন্দার জন্য সুবর্ণকেও দুদিন আনিয়া রাখা হইল। সুবর্ণ ফিরিয়া গেলে, একদিন মন্দা বলিল, া বৌ, একটা কথা বলি তোমায়, ভালো করে তাকিয়ে দেখেছ বৌমার দিকে? আমার যেন সন্দেহ হল বৌ।
শ্যামা চমকাইয়া উঠিল। তারপর হাসিয়া বলিল, না, ঠাকুঝি, ও তোমার চোখের ভুল।
মন্দার চোখের ভুলকে শ্যামা কিন্তু ভুলিতে পারি না, দিবারাত্রি মনে পড়িতে লাগিল সুবর্ণকে আর মন্দার ইঙ্গিত। কি বলিয়া গেল মন্দা? সত্য হইলে শ্যামা কি অন্ধ, তার চোখে পড়িত না? শ্যামা বড় অন্যমনস্ক হইয়া গেল। সংসারের কাজে বড় ভুল হইতে লাগিল শ্যামার। কি মন্ত্র মন্দা বলিয়া গিয়াছে, সুবর্ণকে দেখিবার জন্য শ্যামার মন ছটফট করে, সে ধৈর্য ধরিয়া থাকিতে পারে না। একদিন মণিকে সঙ্গে করিয়া সে চলিয়া গেল বাগবাজারে। মন্দার মন্ত্র কি শ্যামার চোখে অঞ্জনও পরাইয়া দিয়াছিল? কই, সুবর্ণের দিকে চাহিয়া এবার তো শ্যামার চোখ পীড়িত হইয়া উঠিল না?
শ্যামা বলিয়া আসিল, সামনের রবিবার দিন ভালো আছে, ওইদিন বিধান আসিয়া সুবর্ণকে লইয়া যাইবে। না, তাকে বলা মিছে, বৌকে সে আর বাপের বাড়ি ফেলিয়া রাখিতে পারিবে না।