শ্যামা মিষ্টি আনাইল, খাইতে পীড়াপীড়ি করিল, হারাধন কিছু খাইল না। খাইতে নাই। বলিয়া গেল, নাতি হইলে যাচিয়া আসিয়া পাতা পাড়িবে। হারাধনকে বিদায় করিয়া শ্যামা সুবর্ণের খোজে গেল।
কোথায় গেল সুবর্ণ? সে তো একতলায় নাই!
সিঁড়ি ভাঙিয়া শ্যামা উপরে গেল। শীতলের পায়ের কাছে মাথা নত করিয়া সুবর্ণ বসিয়া আছে, তার কোলে শ্যামার অন্ধ মেয়েটি। থাবা পাতিয়া বসিয়া ফণী হাঁ করিয়া বৌদিদির মুখখানা। দেখিতেছে, আহ্লাদে গদগদ হইয়া মণি কথা কহিতে গিয়া টোক গিলিতেছে। ধীরে ধীরে শীতল কি যেন জিজ্ঞাসা করিতেছে সুবর্ণকে। সুবর্ণের মুখখানা ঈষৎ আরক্ত, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চন্দনের স্বচ্ছ ফোটার মতো।
ঘরের মেয়ে? তাই তো বটে। তার স্বামী-পুত্রের মাঝখানে ওকে তো অনভ্যস্ত, আকস্মিক আগন্তুক মনে হয় না। ঘরের মেয়ের মতোই যে দেখাইতেছে সুবর্ণকে?
শ্যামা আগাইয়া গেল, বলিল, বৌমা, কিছু খাও নি বিকেলে, এস তোমায় খেতে দিই।
নতুন বৌয়ের আর ভালোমন্দ কি; সে তো শুধু এতকাল লজ্জা, ভয়, নম্রতা, তবুও ওর মধ্যেই মনটা বোঝা যায়, সরল না কুটিল, কুঁড়ে না কাজের লোক। মা-হারা মেয়ে? কথাটা শ্যামার মনে থাকে না–তুমিই আমার হারানো মা, বলিয়া শ্যামার স্নেহের ভাণ্ডরে ডাকাতি করিবার মেয়েও সুবর্ণ নয়, সে সরল কিন্তু বুদ্ধিমতী, কাজের মানুষ কিন্তু কুরমণী নয়। দরকার মতো একখানা দুখানা বাসন সে বাসন মাজার মতোই মাজিয়া আনে, কাজটুকু করিতে পাইয়া এমন উৎফুল্ল হইয়া। ওঠে না যে মনে হইবে পুষ্প-চয়ন করিতে পাইয়াছে। শাশুড়ির হাতের কাজ কাড়িয়া যে বৌ কাজ। করে কোনো শাশুড়িই তাকে দেখিতে পারে না, সুবর্ণ সে চেষ্টা করে না, স্বাভাবিক নিয়মে যে সব কাজ শ্যামার হাত হইতে খসিয়া তাহার হাতে আসে মন দিয়া সেইগুলিই সে করিয়া যায়, আর একটি সজাগ দৃষ্টি পাতিয়া রাখে শ্যামার মুখে, আলো নিভিয়া মেঘ ঘনাইয়া আসিবার উপক্রমেই চালাক মেয়েটা ত্রুটি সংশোধন করিয়া ফেলে।
নেহাত দোষ করিয়া ফেলিলে প্রয়োগ করে একেবারে চরম অস্ত্র। চোখ দুটা জলে টাবুটুবু ভৰ্তি করিয়া শ্যামার সামনে মেলিয়া ধরে। ভালো করিয়া শুরু করার আগেই শ্যামার মুখের কথাগুলি জমিয়া যায়।
শ্যামা হঠাৎ সুর বদলাইয়া সস্নেহে হাসিয়া বলে, আ আবাগীর বেটি, এই কথাতে চোখে জল এল। কি আর বলেছি মা তোক এ্যাঁ?
চোখ! অশ্রুসজল চোখকে শ্যামা বড় ডরায়। মানুষের চোখের সম্বন্ধে সে বড় সচেতন। চোখ ছিল তার বকুলের আর চোখ হইয়াছে বকুলের মেয়েটার! শ্যামার মেয়েটি অন্ধ, এত যে আলো জগতে একটি রেখাও তার খুকির চেতনায় পৌছায় না। সজল চোখে চাহিয়া যে কোনো দৃষ্টিলতী শ্যামাকে সম্মোহন করিতে পারে।
বড় দোটানায় পড়িয়াছে শ্যামা।
ছেলের বৌটাকে ভালবাসিবে কি বাসিবে না।
এমনি মন্দ লাগে না, মায়া করিতে ইচ্ছা হয়, বকুল যে ফাকটা রাখিয়া গিয়াছে সুবর্ণকে দিয়া তাহা ভরিয়া তুলিবার কল্পনা প্রায়ই মনে হয় শ্যামার। কিন্তু হঠাৎ তাহার চমক ভাঙে, উঃ একি হিল্লোল তুলিয়া সামনে দিয়া হটিয়া গেল বৌ, একি আগুন ওর দেহময়? এমন করিয়া কে ওকে গড়িয়াছিল, রক্ত-মাংসের এই মোহিনীকে? সুবর্ণ স্নান করে, চাহিয়া দেখিয়া শ্যামার বুকের রক্ত যেন শুকাইয়া যায়। বড় ভয় করে শ্যামার। কে জানে ওর ওই ভয়ানক সুন্দর দেহের আকর্ষণে কোথা দিয়া অমঙ্গল ঢুকিবে সংসারে।
কড়া শীতে যেমন হইয়াছিল, চড়া গরম পড়িতে শ্যামার শরীর আবার তেমনি খারাপ হইয়া গেল। এবার একটা অতিরিক্ত উপসর্গ দেখা দিল–তিরিক্ষে মেজাজ। অল্পে অল্পে আরম্ভ করিয়া। জ্যৈষ্ঠের শেষে বকুনি ছাড়া কথা বলাই যেন সে বন্ধ করিয়া দিল। থাকে থাকে তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া ওঠে, যাকেই পায় তাকেই যত পারে বকে, তারপর অদৃষ্টের নিন্দা করিতে করিতে কাঁদিয়া ফেলে। শ্যামার ভয়ে বাড়িসুদ্ধ সকলের মুখ সর্বদা শুকনো দেখায়। সবচেয়ে মুশকিল হয় সুবর্ণের। অন্য সকলে শ্যামার সম্মুখ হইতে পলাইয়া বাঁচে, তার তো পালানোর উপায় নেই। তার উপর বিধান আবার তাহাকে হুকুম দিয়া রাখিয়াছে, সব সময় কাছে কাছে থাকবে মার, যা বলেন শুনবে, আগুনের আঁচে বেশি যেতে দেবে না, ওপোর-নিচ করতে দেবে না, সেবাযত্ন করবে মার শরীর ভালো নয় জান তো? বিধান বলিয়াই খালাস, সকালে উঠিয়া ছেলে পড়াইতে যায়, বাড়ি ফিরিয়াই ছোটে আপিসে, ফেরে সন্ধ্যার পর, সারাদিন শ্যামা কি কাণ্ড করে সে তো দেখিতে আসে না, সুবর্ণের অবস্থা সে কি বুঝিবে কিছু বলিবার উপায়ও সুবর্ণের নাই। কি বুলিবে? যদি বলিতে যায়, বিধান যে ভাবিয়া বসিবে—দ্যাখ এর মধ্যে নালিশ করা শুরু হইয়াছে।
কিন্তু বিধান সব বোঝ। চিরকাল বুঝিয়া আসিয়াছে। সুবর্ণ এখনো জানে না যে বুঝিয়াও বিধান কোনোদিন কিছু বলে না, চুপচাপ নিজের কাজ করিয়া যায়, চুপচাপ উপায় ঠাওরায়। বনগাঁয় শ্যামা একবার পাগল হইতে বসিয়াছিল এবারো সেই রকম আরম্ভ হইয়াছে দেখিয়া বিধান কম ভয় পায় নাই, প্রতিবিধানের কোনো উপায় শুধু সে খুঁজিয়া পাইতেছে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যঘটিত, শ্যামাকে লইয়া কোথাও চেঞ্জে যাইতে পারিলে ভালো হইত, কোনো ঠাণ্ডা দেশে দার্জিলিং অথবা সিমলা। সে অনেক টাকার কথা। অত টাকা কোথায় পাইবে সে?
সংসার চালানোর ভাবনাতেই এই বয়সে সে বুড়ো হইয়া গেল। এ বাড়িতে সে ছাড়া আর সকলেই বোধহয় ভুলিয়া গিয়াছে বাড়িটা পর্যন্ত তাদের নয়, মাসে মাসে ভাড়া নিতে হয় বিধানকে।