দিন কুড়ি থাকিয়া মন্দা চলিয়া গেল। আসিল নববর্ষ আর গ্রীষ্ম। শীতের শেষে শ্যামার শরীরটা ভালো হইয়াছিল, গরমে আবার যেন সে দুর্বল হইয়া পড়িল। কাজ করিতে শ্রান্তি বোধ হয়। সন্ধ্যার সময় হাত-পা চিবাইতে থাকে। কিন্তু কাহাকেও সে তাহা বুঝিতে দেয় না, চুপ করিয়া থাকে। কেন, দুর্বল শরীরে খাটিয়া মরে কেন শ্যামা? তার সেবা করার জন্য ছেলে না তার বিবাহ করিয়াছে? বৌকে আনাইয়া লইলেই তো এবার সে অনায়াসে বসিয়া বসিয়া আয়াস করিতে পারে। কিন্তু কেন যেন বৌকে আনিবার ইচ্ছা শ্যামার হয় না। না আনিলে অবশ্য চলিবে না, ছেলের বৌকে কি বাপের বাড়ি ফেলিয়া রাখা যায় চিরদিন? যাক, দুদিন যাক।
একদিন বিধান আপিস গিয়াছে, কোথা হইতে রঙিন খাম আসিল একখানা, আকাশের মতো নীল রঙের। শ্যামা অবাক হইয়া গেল! এর মধ্যে চিঠি লিখিতে শুরু করিয়াছে বৌ? ওদের ভাব হইল কবে? কদিনেরই বা দেখাশোনা। বিধান লুকাইয়া যায় না তো শ্বশুরবাড়ি? নিজের মনে শ্যামা হাসে। লুকাইয়া শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ছেলেই বটে তার। কি লিখিয়াছে বৌ। চিঠিখানা সে বিধানের মশারির উপর রাখিয়া দিল।
বিধান আসিলে বলিল, তোর একখানা চিঠি এসেছে খোকা রেখে দিয়েছি মশারির ওপর।
বিধান চিঠি পড়িয়া পকেটে রাখিয়া দিল।
–বাগবাজারের চিঠি বুঝি? ওরা ভালো আছে?–শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল।
বিধান বলিল, আছে।
ছেলের সংক্ষিপ্ত জবাবে শ্যামা যেন একটু রাগ করিয়াই সরিয়া গেল।
কয়েকদিন পরে একটা ছুটির দিনে শ্যামা একটু বিশেষ আয়োজন করিয়াছিল রান্নার। রাঁধিতে রধিতে অনেক বেলা হইয়া গেল। রান্নাঘরের ভিতরটা অসহ্য গরম, শ্যামা যেই বাহিরে আসিয়া। দাঁড়াইয়াছে অমনি মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। সামান্য ব্যাপার, মূৰ্ছাও নয়, সন্ন্যাস-রোগও নয়, মাথায় একটু জলটল দিতেই শ্যামা সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিল। বিধান কিন্তু তাহাকে সেদিন আর উঠিতে দিল না, শোয়াইয়া রাখিল। বিকালে বিধান বাহির হইয়া গেল। রাত্রি আটটার সময় ফিরিয়া আসিল সুবর্ণকে সঙ্গে করিয়া।
বিধানের নিষেধ অমান্য করিয়া শ্যামা তখন রাঁধিতে গিয়াছে। সুবর্ণ প্ৰণাম করিতে সে একেবারে উত্তেজিত হইয়া উঠিল।
–একি রে খোকাঃ বলা নেই কওয়া নেই বৌমাকে নিয়ে এলি যে তুই? জিজ্ঞেস করা দরকার মনে করলি নে বুঝি একবার?
এরকম অভ্যর্থনার জন্য বিধান প্রস্তুত ছিল না। সে চুপ করিয়া রহিল। সুবর্ণকে দেখিয়া শ্যামা খুশি হয় নাই? তার সেবা করার জন্য সে যে হঠাৎ বৌকে লইয়া আসিয়াছে এটা সে খেয়াল করিল না? বিধান দুঃখিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুবর্ণের কি হইল বোঝা গেল না।
শ্যামা মণিকে বলিল, যা তো মণি, তোর বৌদিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা গে।…কি সব কাণ্ড বাবা এদের, রাতদুপুরে হুট করে নতুন বৌকে এনে হাজির–কিসে কি ব্যবস্থা হবে এখন?
বিধান ভয়ে ভয়ে বলিল, বাইরে তোমার বেয়াই বসে আছেন মা।
তাকেও এনেছি? আমি পারব না বাবু রাতদুপুরে রাজ্যের লোকের আদর আপ্যেন করতে, মাথা বলে ছিঁড়ে যাচ্ছে–কি বলে ওদের তুই নিয়ে এলি খোকা? এক ফোঁটা বুদ্ধি কি তোর নেই?
কি রাগ শ্যামার! ছেলেবেলায় যাকে সে ধমক দিতে ভয় পাইত সেই ছেলেকে কি তার শাসন! গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়াই সে রাঁধিতে আসিয়াছিল। সুবর্ণকে দেখিয়াই তার মাথা ধরিয়া গেল, বেশ গা-হাত চিবাইতে আরম্ভ করিল, শ্যামার অন্ত পাওয়া ভার। কি শোচনীয়ভাবে তার মনের জোর কমিয়া গিয়াছে। তারই সেবার্থে পরিণীতা পত্নীকে তারই সেবার জন্য অসময়ে বিধান টানিয়া লইয়া আসিয়াছে–শুধু অনুমতি নেয় নাই, আগে ছেলের এই কাণ্ডে শ্যামা কত কৌতুক বোধ করিত, কত খুশি হইত, আজ শুধু বিরক্ত হওয়া নয়, বিরক্তিটুকু চাপা পর্যন্ত রাখতে পারিতেছে না। এ আবার কি রোগ ধরিল শ্যামাকে?
ছেলে একটি যৌবনোচ্ছলা মেয়েকে বাছিয়া বিবাহ করিয়াছে বলিয়া জননীর কি এমন অবুঝ হওয়া সাজে।
ছেলে তো এখনো পর হইয়া যায় নাই? মেনকা উর্বশী তিলোত্তমার মোহিনী মায়াতেও পর হইয়া যাওয়ার ছেলে তো সে নয়? শ্যামা কি তা জানে না? এমন অন্ধ জ্বালাবোধ কেন তার?
বোধহয় হঠাৎ বলিয়া, ওরা খবর দিয়া আসিলে এতটা হয়তো হইত না। ক্রমে ক্রমে শ্যামা শান্ত হইল। একবার পরনের কাপড়খানার দিকে চাহিল–না, হলুদ-কালি-মাখা এ কাপড়ে কুটুমের সামনে যাওয়া যায় না।—যা তো খোকা চট করে ওপোর থেকে একটা সাফ কাপড় এনে দে তো আমায়। কাপড় বদলাইয়া শ্যামা বাহিরের ঘরে গেল। হারাধন বিধানের বিছানায়। বসিয়াছিল, শীর্ণদেহ লম্বাকৃতি লোক, হাতের ছাতিটার মতো জরাজীর্ণ, দেখিতে অনেকটা সেই পরান ডাক্তারের মতো।
শ্যামাকে দেখিয়া হারাধন বুঝি একটু অবাক হইল। বলিল, আহা আপনি কেন উঠে এলেন? কেমন আছেন এখন?
শ্যামা বলিল, খোকা বুঝি বলেছে আমার খুব অসুখ?
হারাধন বলিল, তাই তো বললে, গিয়ে একদণ্ড বসলে না, তাড়াহুড়ো করে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল–কাপড় কখানা গুছিয়ে আনার সময়ও মেয়েটা পায় নি। মেয়ের মাসি কেঁদে মরছে, এমন করে কেউ মেয়ে পাঠাতে পারে বেয়ান?
বোঝা গেল, শ্যামাকে সুস্থ দেখিয়া হারাধন অসন্তুষ্ট হইয়াছে। হারাধনের অসন্তোষে শ্যামা কিন্তু খুশি হইল। মধুর কণ্ঠে বলিল, অমনি পাগল ছেলে আমার বেয়াই, আমার একটু কিছু হলে কি করবে দিশে পায় না। সকালে উনুনের ধার থেকে বাইরে এসে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল, পড়ে গেলাম উঠানে, তাইতে ভড়কে গেছে ছেলে।–বড় তো কষ্ট হল আপনাদের?