লজ্জায় দুঃখে ছেলের মুখের দিকে শ্যামা চাহিতে পারে না। রূপ ও সুষমাই যথেষ্ট নয়, ছেলে তার যৌবন চায়। দেহ অপরিপুষ্ট হইলে ছবির মতো সুন্দরী মেয়েও ওর পছন্দ হইবে না। ছি, একি রুচি বিধানের?
ওরকম বৌ আসিলে শ্যামা তো তাকে ভালবাসিতে পারিবে না।
আবার মেয়ে খোজা হইতে লাগিল। মেয়ে খুঁজিতে খুঁজিতে কাবার হইয়া গেল মাঘ মাস।
ফারুনের গোড়ায় শীত কমিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে শ্যামা সতেজ সুস্থ হইয়া উঠিল!
ফাল্লুনের শেষের দিকে বাগবাজারের উকিল হারাধনবাবুর মা-হারা মেয়েটার সঙ্গে বিধানের বিবাহ হইয়া গেল। মেয়ের নাম সুবর্ণলতা।
শ্যামা যা ভাবিয়াছিল তাই। মস্ত ধাড়ি মেয়ে, যৌবনের জোয়ার নয় একেবারে বান। ডাকিয়াছে। রং মন্দ নয়, মুখ চোখ মন্দ নয়, কিন্তু শ্যামার চোখে ওসব পড়িল না, সে সভয়ে শুধু বৌয়ের সুস্থ ও সুন্দর শরীর দেখিয়া মনে মনে সকাতর হইয়া রহিল।
বাড়ন্ত বৌ এনেছ, না গো?–বলিল সকলে।
হ্যাঁ বাছা, জেনেশুনেই এনেছি, ছোট মেয়ে ছেলেরও পছন্দ নয়, আমারও নয়। একা আর পেরে উঠিনে মা সংসারের ঘানি টানতে, বড়সড় বৌটি এল, শেখাতে হবে না কিছু, নিজেই সব পারবে।—বলিয়া শ্যামা কষ্টে একটু হাসিল।
তা, মন্দ কি বৌ? প্রিতিমের মতো মুখখানা।–সকলে বলিল।
তাই নাকি? শ্যামা ভালো করিয়া সুবর্ণের মুখের দিকে চাহিল। তা হইবে।
বিবাহ উপলক্ষে বকুল আসিয়াছিল, রাখালের সঙ্গে মন্দাও আসিয়াছিল। বকুল আসিয়াছিল তিন দিনের জন্য, বিবাহের হৈচৈ থামিবার আগেই সে চলিয়া গেল। বৌকে ভালো লাগিয়াছে। বকুলের। যাওয়ার সময় এই কথা সে শ্যামাকে বলিয়া গেল।
শ্যামা বলিল, তোর কি পছন্দ বুঝি নে বাপু, এত কি ভালো যে একেবারে গদগদ হয়ে। গেলি?
বকুল বলিল, দেখ, ও বৌ যদি ভালো না হয় কান কেটে নিও আমার, মা-মরা মেয়ে। একটু আদর যত্ন পাবে যার কাছে প্রাণ দেবে তার জন্যে। কি বলছিল জান? বলছিল তুমি নাকি ওর মার মতো।
তাই নাকি? তা হইবে।
বকুল চলিয়া গেল, বৌ চলিয়া গেল, বিবাহ বাড়ি নিঝুম হইয়া আসিল, রহিয়া গেল মন্দা। এই তো সেদিন শ্যামা মন্দার আশ্রয় ছাড়িয়া আসিয়াছে, দাসীর মতো খাটিয়াছে মন্দার সংসারে, অহোরাত্র মন যুগাইয়া চলিয়াছে, সে স্মৃতি ভুলিবার নয়। একবিন্দু কৃতজ্ঞতা নাই শ্যামার, মন্দা রহিয়া গেল বলিয়া সে এতটুকু কৃতার্থ হইয়া গেল না! কয়েক বছর আশ্রয় দিয়াছিল বলিয়া শ্যামার কাছে কি সমাদর মন্দা আশা করিয়াছিল সে-ই জানে, বোধহয় ভাবিয়াছিল আজো শ্যামার উপর কর্তৃত্ব করিতে পারিবে। কিন্তু সে না পাইল মনের মতো সমাদর, না পারিল কোনোদিকে কর্তৃত্ব করিতে। শ্যামার সংসারে কি কর্তৃত্ব আর সে করিতে চাহিবে, ভালো করিয়া আবার শীতলের চিকিৎসা করানোর জন্যেই তাহার উৎসাহ দেখা গেল সবচেয়ে বেশি। বলিল, রয়ে কি গেলাম সাধে? কি করে রেখেছ আমার দাদাকে। দাদাকে ভালো না করে আমি এখান থেকে নড়ছি নে বৌ।
কত সে দরদী বোন, কত তার ভাবনা। কে জানে, হইতেও পারে। আজ তো সপুত্র সকন্যা শ্যামার ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয়, কিছুই তো ওদের জন্য আর তাহাকে করিতে হইবে না, শীতলের জন্য হয়তো তাই আন্তরিক ব্যাকুলতাই মন্দার জাগিয়াছে। শ্যামাকে সে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল।
শ্যামা বলিল, ওর আর চিকিচ্ছে নেই ঠাকুরঝি, ওর চিকিচ্ছে এখন সেবাযত্ন।
মন্দা স্তম্ভিত হইয়া বলিল, মুখ ফুটে এমন কথা তুমি বলতে পারলে বৌ। তুমি কি গো, এ্যাঁ?
শ্যামা বলিল, কি বলতে হবে তুমিই না হয় তবে বলে দাও?
মন্দা রাগিয়া উঠিল, কাঁদিয়াও ফেলিল। কে জানে অকৃত্রিম বেদনায় মন্দা কাতর হইয়াছে। কিনা! এ তো অর্থ সাহায্যের কথা নয়, ভারবহনের কথা নয়, ভাইয়ের জীবন তাহার। চিকিৎসা নাই, ভাই তাহার বাঁচিবে না? মন্দার হয়তো ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। শীতলের অসংখ্য পাগলামি আর অজস্ৰ স্নেহ–বড় ভালবাসিত শীতল তাহাকে। সেই দিনগুলি কোথায় হারাইয়া গিয়াছে, কিন্তু এই বাড়িতেই সে সব ঘটিয়াছিল। এখানে বসিয়া অনায়াসে কল্পনা করা চলে সে সব। ইতিহাস। হয়তো তাই মন্দার কান্না আসে।
বলে, দাদার জন্যে কিছুই করবে না তুমি? ডাক্তার কবরেজ দেখাবে না?
শ্যামা বলে, ডাক্তার কি দেখানো হয় নি ঠাকুরঝি? ডাক্তার না দেখিয়ে চুপ করে বসে আছি আমি? ষোল টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার এনেছি, কলকাতার সেরা কবরেজকে দেখিয়েছি–জবাব দিয়েছে সবাই। আমি আর কি করব?
তবে আর কি, কর্তব্য করেছ, এবার টান দিয়ে ফেলে দাও দাদাকে রাস্তায়। আজ বুঝতে পারছি বৌ দাদা কেন বিবাগী হয়ে গিয়েছিল।
এতকাল পরে মন্দা তবে শ্যামাকে চিনিতে পারিয়াছে?
শীতলের পায়ের কাছে বসিয়া মন্দা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। চমকাইয়া উঠিয়া বড় ভয় পায় শীতল। দাড়ির ফাঁকে একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করে, আমার সেই কুকুরটা আছে মন্দা?
দাদা গো।–বলিয়া মন্দা হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ওঠে।
শীতল থরথর করিয়া কপিতে থাকে। মনে হয় আর কিছুদিন যদিবা সে বাঁচিত মন্দার বুকফাটা কান্নায় এখুনি মরিয়া যাইবে। বড় কষ্ট হয় শীতলের, বড় ভয় করে। বড় বড় কালো লোমশ পা ফেলিয়া নিজের মরণকে সে যেন আগাইয়া আসিতে দেখিতে পায়। বিহ্বল দৃষ্টিতে সে চাহিয়া থাকে মন্দার দিকে।
দরজার কাছে দাঁড়াইয়া শ্যামা বলে, ঠাকুরঝি, শোন, বাইরে এস একবার—
সকলেই বুঝিতে পারে মরণাপন্ন মানুষের কাছে এভাবে কাঁদিতে নাই এই কথা বলিতে চায় শ্যামা। মন্দা চোখ মুছিয়া উদ্ধত ভঙ্গিতে সোজা হইয়া বসে। বেশ করিয়াছে কাঁদয়া। শীতলও বুঝি তাই মনে করে। মন্দার আকস্মিক কান্নায় আঁতকাইয়া উঠিয়া তাহার দম বন্ধ হইয়া আসিয়াছিল, তবু শ্যামার বিবেচনার চেয়ে যে দরদের কান্না মারিয়া ফেলার উপক্রম করে তাই বুঝি ভালো শীতলের কাছে। কি উৎসুক চোখে সে মন্দার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। ছেলেবেলা বকুল আর বনগাঁয় মন্দার সেই কুকুরটা ছাড়া এ জগতে সকলে ফাঁকি দিয়াছে শীতলকে।