শ্যামা বলে, ছেলে যে বিয়ের কথা কানে তোলে না বাবা? বলে মাইনে বাড়ুক। ছেলের মত নাই, বিয়ে দেব কার?
এ বাড়িতে আসিয়া বিবাহের জন্য ছেলেকে শ্যামা যে পীড়াপীড়ি করিয়াছে তা নয়, ভয়ে সে চুপ করিয়া আছে, ধরিয়া লইয়াছে বিবাহ বিধান এখন করিবে না। এর মধ্যে শামুকে বিধান কি আর ভুলিতে পারিয়াছে? যে মায়াজাল ছেলের চারিদিকে কুহকী মেয়েটা বিস্তার করিয়াছিল কয়েক মাসে তাহা ছিন্ন হইবার নয়। শামুর অজস্ৰ হাসি আজো শ্যামার কানে লাগিয়া আছে। এখন ছেলেকে বিবাহের কথা বলতে গিয়া কি হিতে বিপরীত হইবে। যে রহস্যময় প্রকৃতি তাহার পাগল ছেলের, কিছুদিন এখন চুপচাপ থাকাই ভালো।
মোহিনী বলে, বিধানবাবুর অমত হবে না মা, আপনি মেয়ে দেখুন।
মোহিনীর বলার ভঙ্গিতে শ্যামা অবাক হইয়া যায়। এত জোর গলায় মোহিনী কি করিয়া ঘোষণা করিতেছে বিধানের অমত হইবে না? বিধানের মন সে জানিল কিসে?
তারপর মোহিনী কথাটা পরিষ্কার করিয়া দেয়। বলে যে কদিন আগে বিধান গিয়াছিল তাহার কাছে, বিবাহের ইচ্ছা জানাইয়া আসিয়াছে।
যেচে বিয়ে করতে চান শুনে প্রথমটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম মা, তারপর ভেবে দেখলাম কি জানেন–আপনার শরীর ভালো নয়, কাজকর্ম করতে কষ্ট হয় আপনার। ভেবেচিন্তে তাই সম্মত হয়েছেন। ওসব কিছু বলবেন না অবিশ্যি, বলবার মানুষ তো নন।
শ্যামা জানে না! পড়া ছাড়িয়া বিধান একদিন হঠাৎ চাকরি গ্রহণ করিয়াছিল, আজ বিবাহে মত দিয়াছে। সেদিন অভাবে অনটনে শ্যামা পাগল হইতে বসিয়াছিল, আজ সংসারে কাজ করতে
তাহার কষ্ট হইতেছে। সেবার বিধান ত্যাগ করিয়াছিল বড় হওয়ার কামনা, এবার ত্যাগ করিয়াছে। মত। শুধু মত হয়তো নয়। মত আর শামুর স্মৃতি হয়তো আজো একাকার হইয়া আছে ছেলের মনে।
তা হোক, ছেলেরা এমনিভাবেই বিবাহে মত দিয়া থাকে, মায়ের জন্য। নহিলে স্বপন। দেখিবার বয়সে কেহ কি সাধ করিয়া বিবাহের ফাঁদে পড়িতে চায়। তারপর সব ঠিক হইয়া যায়। বৌয়ের দিকে টান পড়িলে তখন আর মনেও থাকে না কিসের উপলক্ষে বৌ আসিয়াছে, কার জন্য। চোখের জলের মধ্যে শ্যামা হাসে। খুঁজিয়া পাতিয়া ছেলের জন্য বৌ সে আনিবে পরীর মতো রূপসী, মার জন্যে বিবাহ করিতে হইয়াছিল বলিয়া দুদিন পরে আর আফসোস থাকিবে না ছেলের–মনে থাকিবে না শামুকে।
শ্যামার মনে আবার উৎসাহ ভরিয়া আসিল। জীবনে কাজ তো এখনো তার কম নয়। আনন্দ উৎসবের পথ তো খোলা কম নয়! এত সে শান্ত হইয়া গিয়াছিল কেন? কত বড় সংসার গড়িয়া উঠিবে তাহার। এখনি হইয়াছে কি! বিধানের বৌ আসিবে, মণির বৌ আসিবে, ফণীর বৌ আসিবে–যে ঘরে ওদের সে প্রসব করিয়াছিল সেই ঘরে এক একটি শুভদিনে আসিতে থাকিবে নাতিনাতনির দল। দোতলায় সে আরো ঘর তুলিবে, পিছন দিকের উঠানে দালান তুলিয়া আরো বড় করিবে বাড়ি! অত বড় বাড়ি হার ভরিয়া যাইবে নবীন নরনারীতে–ও-বাড়ির নকুবাবুর শাশুড়ির মতো মাথায় শণের নুড়ি ঝুলাইয়া কুঁজো হইয়া সে দাঁড়াইয়া থাকিবে জীবনের সেই বিচিত্র উজ্জ্বল আবর্তের মাঝখানে।
সবই তো এখনো তাহার বাকি?
কেবল একটা দুঃখ তাহাকে আজীবন দহন করিবে। তার অন্ধ মেয়েটা। ওর জন্য অনেক চোখের জল ফেলিতে হইবে তাহাকে।
শ্যামা মেয়ে খুঁজিতে লাগিল। সুন্দরী, সদ্বংশজাত, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, কিছু কিছু গান বাজনা লেখাপড়া সেলাইয়ের কাজ জানা, চৌদ্দ-পনের বয়সের একটি মেয়ে। খানিকটা শামুর মতে, খানিকটা শ্যামার ভাড়াটে সেই কনকের মতো আর খানিকটা শ্যামার কল্পনার মতো হইলেই ভালো হয়। টাকা শ্যামা বেশি চায় না, অসম্ভব দাবি তার নাই।
কয়েকটি মেয়ে দেখা হইল, পছন্দ হইল না। তারপর পাড়ার একবাড়ির গৃহিণী, শ্যামার সঙ্গে তার মোটামুটি আলাপ ছিল, একটি খুব ভালো মেয়ের সন্ধান দিলেন। শহরের অপর প্রান্তে গিয়া মেয়েটিকে দেখিবামাত্র শ্যামা পছন্দ করিয়া ফেলিল। বড় সুন্দরী মেয়েটি, যেমন রং তেমনি নিখুঁত মুখ চোখ। আর কোমল আর ক্ষীণ আর ভীরু। শ্যামাকে যখন সে প্রণাম করিল মনে হইল দেহের ভার তুলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না, এমন নরম সে মেয়ে, এত তার কোমলতা।
মেয়ে পছন্দ করিয়া শ্যামা বাড়ি ফিরিল। সে বড় খুশি হইয়াছে। এমন মেয়ে যে খুজিলেও মেলে না। কি রূপ, কি নম্রতা। ওর কাছে কোথায় লাগে শামু?
মোহিনীর সঙ্গে বিধানকে সে একদিন জোর করিয়া মেয়ে দেখিতে পঠাইয়া দিল। ফিরিয়া আসিয়া মোহিনী বলিল, না মা, পছন্দ হল না মেয়ে।
শ্যামা যেন আকাশ হইতে পড়িল।
কার পছন্দ হল না, তোমার?
আমার পছন্দ হয়েছে। বিধানবাবুর পছন্দ নয়।
পছন্দ নয়? ওই মেয়ে পছন্দ নয় বিধানের? বাংলাদেশ খুঁজিলে আর অমন মেয়ে পাওয়া যাইবে? বিধান বলে কি?
কেন পছন্দ হল না খোকা?
বিধান বলিল, দূর, ওটা মানুষ নাকি? ফুঁ দিলে মটকে যাবে।
না, শামুকে ছেলে আজো ভোলে নাই। শামুর নিটোল গড়ন, শামুর চপল চঞ্চল চলাফেরা, শামুর নির্লজ্জ দুরন্তপনা আজো ছেলের দৃষ্টিকে ঘিরিয়া রহিয়াছে, আর কোনো মেয়েকে তার পছন্দ হইবে না। শ্যামার মুখে বিষাদ নামিয়া আসে। ফুঁ দিলে মটকাইয়া যাইবে? মেয়েমানুষ আবার ফুঁ দিলে মটকায় নাকি। শামুর মতো সবল দেহ থাকে কটা মেয়ের? থাকা ভালোও নয়। কাঠ কাঠ দেখায়, পাকা পাকা দেখায়, অসময়ে সর্বাঙ্গে যৌবন আসিলে কি বিসদৃশ দেখায় মেয়েমানুষকে বিধান তার কি জানে? ও যে ধ্যান করিতেছে শামুর, শামুর পুরন্ত সুঠাম দেহটা যে চোখের সামনে ভাসিয়া বেড়াইতেছে ওর।