অনেক ভাবিয়া শ্যামা শেষে একদিন বকুলকে বলে, শোন খুকি বলি, দ্যাখ শামুকে যদি খোকার পছন্দ হয়ে থাকে, ওর সঙ্গেই না হয় দিই খোকার বিয়ে? স্বঘর তো, দোষ কি?
বকুল স্তম্ভিত হইয়া যায়, বলে, ক্ষেপেছ নাকি তুমি মা, কি বলছ তার ঠিক-ঠিকানা নেই, ওই মেয়ের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও দাদার! শামু ভালো নয় মা–শয়তানের একশেষ। এমন মনেও ঠাঁই দিও না।
কি হইবে তবে? একদিন শামু না আসিলে বিধান যে উসখুস করিতে থাকে। শামুর হাসির হিল্লোলে সংসার যে শ্যামার ভাসিয়া যাইতে বসিয়াছে!
ভগবান মুখ তুলিলেন।
অনেক দুঃখ শ্যামা পাইয়াছে, আর কি তিনি তাকে কষ্ট দিতে পারেন। একদিন বিধান বলিল, শঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম মা, আমাদের বাড়িটা দেখে আসতে ইচ্ছে হল, গিয়ে দেখি। ভাড়ার নোটিশ ঝুলছে। যাবে ও বাড়িতে?
আমাদের বাড়ি! আজো সেবাড়ির কথা বলিতে ইহারা বলে আমাদের বাড়ি!
শ্যামা সাগ্রহে বলিল, সত্যি খোকা?–যাব, চল সামনের মাসেই আমরা চলে যাই, পয়লা তারিখে।
সামনের মাসে পয়লা তারিখে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহারা বাড়ি বদলাইয়া ফেলিল। বিধান ছুটি লইল একদিনের। সকালে একা গিয়া জিনিসপত্র রাখিয়া আসিতে বেলা তার বারটা বাজিয়া গেল। শামু আর বিভা দুজনেই তখন স্কুলে গিয়াছে, বাড়িওলার ছেলেরা গিয়াছে আপিসে, বনবিহারী গিয়াছে ওষুধ ক্যানভাস করিতে। দুপুরে এখানেই পাতা পাতিয়া তাহারা ভাত খাইল। তারপর বাকি জিনিসপত্রসমেত রওনা হইয়া গেল শহরতলির সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে, শ্যামার জীবনের দুটি যুগ যেখানে কাটিয়াছিল।
তেমনি আছে ঘরবাড়ি শ্যামার। এ বাড়ি হইতে সে যখন বিদায় লইয়াছিল তখন বাড়িটা শুধু ছিল একটু বিবৰ্ণ, বাড়ির মালিক এখন আগাগোড়া চুনকাম করিয়াছে, রং দিয়াছে। শ্যামা সোজা উঠিয়া গেল উপরে। উপরের ঘরখানাকে আর নূতন বলিয়া চেনা যায় না, বাড়ির বাকি অংশের সঙ্গে মিশ খাইয়া গিয়াছে। নতুবাবু দোতলায় ঘর তুলিয়াছে একখানা। রেলের বাঁধটার খানিকটা আড়াল পড়িয়া গিয়াছে। আর কিছুই বদলায় নাই। ধানকলের বিস্তৃত অঙ্গনে তেমনি ধান মেলা আছে, পায়রার ঝক তেমনি খাইতেছে ধান, উঁচু চোঙাটা দিয়া তেমনি অল্প অল্প ধোঁয়া বাহির হইয়া উড়িয়া যাইতেছে বাতাসে।
১০. শ্যামার কোলে স্পন্দিত হইতে লাগিল জীবন
বকুলের একটি মেয়ে হইয়াছে।
প্রথমবারেই মেয়ে? তা হোক। শ্যামার শেষবারের মেয়ের মতো ও তো অন্ধ হইয়া জন্মায় নাই, বকুলের চেয়েও ওর বুঝি চোখ দুটি ডাগর। কাজল দিতে দিতে ওই চোখ যখন গভীর কালো হইয়া আসিবে দেখিয়া অবাক মানিবে মানুষ। কি আসিয়া যায় প্রথমবার মেয়ে হইলে, মেয়ে যদি এমন ফুটফুটে হয়, এমন অপরূপ চোখ যদি তার থাকে?
শ্যামার একটু ঈৰ্ষা হইয়াছিল বৈকি! বকুলের মেয়ের চোখ আশ্চর্য সুন্দর হোক শ্যামার তাতে আনন্দ, আহা তার মেয়েটির চোখ দুটি যদি অন্ধ না হইত।
বকুলের মেয়ে মানুষ করে শ্যামা, প্রসবের পর বকুলের শরীরটা ভালো যাইতেছে না, তাছাড়া সন্তান পরিচর্যার সে কি জানে? নিজের মেয়ে, বকুল আর বকুলের মেয়ে, শ্যামা তিনজনেরই সেবা করে। বকুলের মেয়ে আর নিজের মেয়েকে হয়তো সে কোনোদিন কাছাকাছি শোয়াইয়া রাখে, বকুলের মেয়ে তাকায় বড় বড় চোখ মেলিয়া, শ্যামার মেয়ের অন্ধ আঁখি দুটিতে পলকও পড়ে না।–পলক পড়িবে কিসে চোখের পাতা যে মেয়েটার জড়ানো। শ্যামার মনে পড়ে বাদুর কথা–মন্দার সেই হাবা মেয়েটা, দিনরাত যে শুধু লালা ফেলিত। এমন সন্তান কেন হয় মানুষের অন্ধ, বোবা, অঙ্গহীন বিকল? কেন এই অভিশাপ মানুষের? এক একবার শ্যামার মনে হয়, হয়তো বকুলের মেয়ে তার মেয়ের চোখ দুটি হরণ করিয়াছিল তাই ওর ডবল চোখের মতত অত বড় চোখ হইয়াছে। তারপর সবিষাদে শ্যামা মাথা নাড়ে। না, এসব অন্যায় কথা মনে আনা উচিত নয়। কিসে কি হইয়াছে কে তা জানে, সত্য মিথ্যা কিছু তো জানিবার উপায় নাই, আবোল-তাবোল যা তা ভাবিলে বকুলের মেয়ের চোখ দুটির যদি কিছু হয়। প্রথম সন্তান বকুলের, বড় সে আঘাত পাইবে।
মেয়ের দু মাস বয়স করিয়া বকুল শ্বশুরবাড়ি গেল। যাওয়ার আগে কি কান্নাই যে বকুল কাঁদিল। বলিল, চেহারা তোমার বডড খারাপ হয়েছে মা, এবার তাকাও একটু শরীরের দিকে, এখনো এত খাটুনি তোমার সইবে কেন এ শরীরে? বিয়ে দিয়ে বৌ আন এবার দাদার, সারা জীবন তো প্রাণ দিয়ে করলে সকলের জন্য এবার যদি না একটু সুখ করে নেবে …
বলিল, আমার যেমন কপাল! সেবা নিয়েই চল্লাম, তোমার কাছে থেকে একটু যে যত্ন করব তা কপালে নেই?
কি গিন্নিই বকুল হইয়াছে। ছাঁচে ঢালা হইয়া আসিতেছে তাহার চালচলন, কথার ধরন! যেন দ্বিতীয় শ্যামা।
শীতকাল। বকুল শ্বশুরবাড়ি গেল শীতকালে। শীতে সংসারের কাজ করিতে এ বছর শ্যামার সত্যই যেন কষ্ট হইতে লাগিল! ছেলেকে আপিসের ভাত দিতে হয়, শীতের সকাল দেখিতে দেখিতে বেলা হইয়া যায়, খুব ভোরে উঠিতে হয় শ্যামার। আগুনের আঁচে রান্না করিয়া আসিয়া রাত্রে লেপের নিচে গা যেন শ্যামার গরম হইতে চায় না, যত সে জড়োসড়ো হইয়া শোয় হাতেপায়ে কেমন একটা মোচড় দেওয়া ব্যথা জাগে, কেমন একটা কষ্ট হয় তাহার। ভোরে এই কষ্ট দেহ লইয়া সে লেপের বাহিরে আসে, আঁচল গায়ে জড়াইয়া হি-হি করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে নিচে যায়। ঠিকা ঝি আসিবে বেলায়, তার আগে কিছু কিছু কাজ শ্যামাকে আগাইয়া রাখিতে হয়। বিধান বাহিরের ঘরে শোয়! ঝি আসিয়া ডাকাডাকি করিলে তাহার ঘুম ভাঙিয়া যায়–শ্যামা তাই আগে সন্তৰ্পণে সদর দরজাটা খুলিয়া রাখিয়া আসে! ঘুম সে ভাঙায় মণির। মণির পরীক্ষা আসিতেছে, নিচের যে ঘরে আগে শ্যামা সকলকে লইয়া থাকিত, সেই ঘরে মণি একা থাকে–পড়াশোনা করে, ঘুমায়। ভোর ভোর ছেলেকে ডাকিয়া তুলিতে বড় মমতা হয় শ্যামার কিন্তু আজো তো তার কাছে ভবিষ্যতের চেয়ে বড় কিছু নাই, জোর করিয়া মণিকে সে তুলিয়া দেয়। বলে, ওঠ বাবা ওঠ, না পড়লে পরীক্ষায় যে ভালো নম্বর পাবি নে?